মন চায় হাজার বছর বেঁচে থাকতে!

প্রকাশিতঃ 9:39 pm | June 25, 2018

:: শিল্পী জলি ::

অনেক আগে আমার এক বন্ধু প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার দিয়ে ছবি তুলিয়েছিল। তবে ছবিগুলো দেখে আমার মনে হয়েছিল ঐ লোকের চেয়েতো আমিই ভালো ছবি তুলতে পারবো। ছোট বেলায় আমরা যখন ফুজি স্টুডিওতে ছবি তুলতে যেতাম পাঁচ-ছয়জনকে এক ফ্রেমের ভেতরে রাখতে ক্যামেরাম্যান পাশের যারা তাদের ঘাড় কাঁত করে দিতেন যেনো বডি না এলেও মাথা থেকে যায় ছবিতে। বন্ধুর ছবিগুলো অনেকটা তেমনই হয়েছিল। আর ঐ ছবির মান দেখেই আমার ক্যামেরার প্রতি আগ্রহী হওয়া। সেই সুবাদে কিছু ছবি এবং পরবর্তীতে ভিডিও’ও করা হয় ওয়েব ক্যাম দিয়ে।

ক্যামেরার মান তেমন ভালো না হলেও মোটামুটি ভালোই সেসব। নিজের ছবি নিজের তোলা। এখনও যেদিন ওসব দেখতে বসি দিন কোথা দিয়ে চলে যায় বলার পথ থাকে না। হারিয়ে যাওয়া সময়গুলো যেনো একেবারে জীবন্ত হয়ে সামনে এসে দাঁড়ায়। হাজারও স্মৃতির আনাগোনা শুরু হয়ে যায়।

আমার বাবা মারা যান অনেক আগে। তখন ছবি তোলাতুলির খুব একটা প্রচলন ছিল না। তদুপরি আট ছেলেমেয়ের জীবন গড়তে তাঁদের ব্যস্ততা ছিল আকাশসম, ছবি তোলার ফুসরত ছিল না। এমন কী বাবার কোন পাসপোর্ট সাইজের ছবিও নেই আমার কাছে। হয়ত বড় বোনের কাছে দু’একটি থাকতেও পারে। বরাবরই ছবি এবং ছবির মালিকানা রাখতে তাকে বিশেষ আগ্রহী দেখেছি। যদি বাবার কোন ছবি তার কাছে থেকে থাকে তাহলে আমারও পাবার সম্ভাবনা রয়েছে। নইলে বাবার পিঠে ছোট্ট উঁচু একটি ফোঁড়ার মত ছিল, চমৎকার দাঁত এবং সেই দাঁতের অহংকার, তাঁর সাথে চুল কাঁটতে যাওয়া, অতি ভালো একজন প্রেমিক মনের মানুষ যিনি মেয়েদেরকে রেসপেক্ট করতেন এমনই কিছু স্মৃতির রূপে মিশ্রিত একটি মানুষ বাবা আমার স্মৃতিতে, মন চাইলেও আজ আমার আর সেই ক্ষমতা নেই তাকে কাগজে এঁকে, বা ছবিতে অথবা ভিডিওতে সেই রূপ দিয়ে দেখি।

সেবার ২০১৫ তে দেশে গিয়ে অসুস্থ মায়ের একটি ভিডিও করেছিলাম। ঐ ভিডিওর মান তখন একটুও ছিল বলে মনে হয়নি। মা এখন আর নেই। চাইলেও তাকে আর দেখা যাবে না ফিরিয়ে এনে। অথচ ঐ ভিডিওটি যখনই দেখি তখনই আবার হারিয়ে যাওয়া মাকে দেখতে পাই। এই অনুভূতি এক কথায় অকল্পনীয়। দেখি আর মনে হয় ইশ্ বাবারও যদি একটি ভিডিও থাকতো আজ !

সময়ের সাথে মানুষের অনেক কিছুই হারিয়ে যায় নিজেরই অজান্তে। নিজেরই আর বলার পথ থাকে না আগে কী ছিল অথচ এখন নেই? চুলে কী করে পাক ধরলো ? কখনই বা? গায়ের রঙও কী রঙ হারালো ? গলার স্বরেও কী কোন পরিবর্তন ঘটলো ? অথচ পাঁচ বছরের ব্যবধানের ভিডিও দেখলেই বোঝা যায় সময় কত মূল্যবান, কী ছিলাম আর কী হলো? কী করে এই আকাশ চুরি ঘটলো?

জাবির শিল্পী আপা এক কালে এত চমৎকার গাইতেন এখনও কী আর তিনি সেভাবে গাইতে পারেন? দম, সুর আজীবন কী একই পর্যায়ে থাকে মানুষের? আমাদের মধ্যে আমার বড় বোন সবচেয়ে বেশী ভালো গাইতে পারে। চিন্তা-চেতনায়, রান্নাবান্না, বুদ্ধিতে আমার দু’বোনের দক্ষতাই আমার চেয়ে অনেক বেশী। আমার অনেক বান্ধবীরাও অনেক ক্ষেত্রেই অনেক বেশী পারদর্শী। তবে তারা সময়ে পরিকল্পিতভাবে ব্যাপক হারে সেগুলোকে কাজে লাগায়নি। তারা যেদিন হারিয়ে যাবে সেদিন হয়ত বোঝাবার আর কোন পথ থাকবে না তারা আসলে কেমন ছিল? তাদের যাপিত জীবন, এবং জীবনবোধই বা কী ছিল ? জীবনের ভুলত্রুটিগুলো? অথবা প্রাপ্তি?

প্রতিটি জীবনই অতি মূল্যবান। মানুষের জীবনই জীবনকে শেখায়, জীবনবোধে পরিণতি ঘটায়। তাই নিজের এই অতি মূল্যবাণ জীবনটিকে হেলাফেলা করে হারিয়ে যেতে দেবার অবকাশ কোথায়? মনুষ্য জীবন অপূর্ব এক সৃষ্টি। নিজের প্রেমে নিজেই বিভোর হয়ে পুরো জীবন কাঁটিয়ে দিলেও কী মন ভরে? যথেষ্ট মনে হয়? নাকি হওয়া উচিত? একটিইতো জীবন ! আহা বড় মধুর এই বেঁচে থাকা। মন চায় হাজার বছর বেঁচে থাকতে।

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

লেখক : মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সমাজকর্মী

কালের আলো/ওএইচ

Print Friendly, PDF & Email