প্রধানমন্ত্রীকে দিতে হবে কঠোর নির্দেশনা

প্রকাশিতঃ 10:13 am | March 19, 2020

পীর হাবিবুর রহমান :

তামাম পৃথিবী করোনাভাইরাসে ভয়ঙ্কর আক্রমণের বিরুদ্ধে সর্বশক্তি দিয়ে লড়াই করছে। পৃথিবীর সর্বোচ্চ শক্তিমান রাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পর্যন্ত এ ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবিলায় সর্বশক্তি নিয়ে নামার পরও প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, তিনি অসহায়। পর্যাপ্ত ইকুইপমেন্ট নেই। চীনের ভয়াবহতার মুখে নির্বিকার থাকায় ইতালি আজ চড়া মাশুলই দিচ্ছে না, মর্গে লাশ রাখার জায়গা নেই। গোটা ইউরোপকেও বিপদগ্রস্ত করেছে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে আজ ’৭১-এর চেয়ে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ ভয়ের ভয়াবহতা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।

স্বাস্থ্যমন্ত্রীসহ সরকারের সকল পর্যায় থেকে বলা হয়েছিল, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় বাংলাদেশের যথেষ্ট সক্ষমতা আছে। বাস্তবে সক্ষমতা কতটুকু, সে অবস্থা ইতালিপ্রবাসীরা আসার পরই বোঝা গেছে। আমরা কার্যত শক্ত মনোবল ছাড়া কোনো প্রস্তুতিই নিইনি। হজ ক্যাম্পকে কোয়ারেন্টাইন করা হলেও দেখা গেছে সেটি এক ঢালাও গণরুম ছাড়া কিছু নয়। দেশে আসা প্রবাসীদেরও আটকে রাখা যায়নি।

পাশের দেশের কোয়ারেন্টাইন ব্যবস্থার সঙ্গেও কোনো মিল নেই। আইইডিসিআর ছাড়া কোথাও করোনাভাইরাস শনাক্ত হয় না। ঢাকায় ১০টি ল্যাব তৈরি করা হচ্ছে রোগী শনাক্তের জন্য। ঢাকায় পাঁচটি হাসপাতাল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আইসোলেশনে যাদের রাখা হবে বা করোনাভাইরাসে আক্রান্তদের যারা চিকিৎসাসেবা দেবেন, তাদের নিজেদের সুরক্ষার যাবতীয় প্রস্তুতি কী পরিমাণ আছে- স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে সারা দেশের কথা বিবেচনা করে এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে।

দেশে প্রয়োজনীয় সেইফটি আইসোলেশন, গাউন, মাস্ক, স্যানিটাইজার, সেইফটি গগলস, পর্যাপ্ত টেস্ট সামগ্রীসহ যা লাগবে তা জরুরি ভিত্তিতে আমদানি করা প্রয়োজন। দেশজুড়ে রোগ নির্ণয়ের জন্য কিট যদি মজুদ না থাকে তাহলে দ্রুত আনার ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। কিউবার চিকিৎসাবিজ্ঞানে খ্যাতি আছে। সমাজতান্ত্রিক কিউবা দাবি করেছে তারা করোনার প্রতিষেধক আবিষ্কার করেছে। দাবি করেছে তাদের ইন্টারফেরন আলফা টু-বি সারিয়ে তুলেছে অনেক করোনা আক্রান্তকে। চীনে দেড় হাজার রোগী সুস্থ হয়েছে। এটি আমদানি করা প্রয়োজন। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে আমরা প্রস্তুত ছিলাম।

হানাদার বাহিনীর আক্রমণের মুখে মানুষ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে, যুদ্ধ করেছে, গ্রামে পালিয়েছে, এমনকি পাশের দেশে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু করোনাভাইরাসের এ ভয়াবহ আক্রমণ একাই লড়তে হচ্ছে অস্ত্র ছাড়া। অর্থাৎ যার কোনো চিকিৎসাই নেই। এবং পাশের বন্ধুরাষ্ট্রসহ তাবৎ পৃথিবীও এ যুদ্ধের মুখোমুখি। মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে অচেনা অজানা অদৃশ্য এ শক্তির সঙ্গে লড়াই অনেক কঠিন। সরকার একা প্রস্তুতি নিলেই হবে না। জনগণকেও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ লড়াইয়ে সচেতন ও দায়িত্বশীলতার সঙ্গে এগিয়ে আসতে হবে। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ঘোষণা করেছে।

বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা যেখানে বলছেন, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার সঙ্গে যত দূর পারা যায়, গৃহবন্দী হয়ে থাকাই সর্বোত্তম ব্যবস্থা। সেখানে আমরা ইতালির মতো ভাইরাসকবলিত দেশ থেকে শরীরে জীবাণু নিয়ে এসে কোয়ারেন্টাইন থেকে পালিয়ে যাচ্ছি। যার কারণে গতকাল সেই পরিবারের একজনকে মৃত্যুর স্বাদ নিতে হয়েছে। অনেকে আত্মীয়-পরিজনের সঙ্গে বিনা পরীক্ষায় একাকার হয়ে মিশে যাচ্ছেন। ভাইরাস ছড়িয়ে দেওয়ার যন্ত্রণাময় পরিস্থিতি তৈরি করছেন। এমনিতেই ১৮ কোটি মানুষের দেশ। যেখানে যাই মানুষ আর মানুষ গিজগিজ করছে। কতটা বোধহীন হলে বিশ্ব যেখানে মহাদুর্যোগের মুখে সেখানে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটি হতেই পরিবার-পরিজন নিয়ে সাধারণ জ্ঞানটুকু হারিয়ে আহাম্মকের মতো দলবেঁধে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে আনন্দ উৎসবে গিজগিজ করছেন। কখন বিষণ্ণ মনে ঘর নিতে হয়, আর কখন মধুচন্দ্রিমায় যেতে হয়, তাও যেন নির্বোধ হয়ে আজ ভুলে যাচ্ছি! কাবাঘর যেখানে বন্ধ হয়ে গেছে।

সৌদি আরবসহ সব মুসলিম দেশ যেখানে সুরম্য মসজিদে জামাতে নামাজ বন্ধ করে বাড়িতে নামাজ পড়ার তাগিদ দিচ্ছে, সেখানে আমাদের মসজিদের নামাজ পড়া এখনো বন্ধ করা যাচ্ছে না। উল্টো করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পেতে লক্ষ্মীপুরে লাখো মুসল্লি একত্রিত হয়েছেন মোনাজাতে। যত বেশি লোকসমাগম তত বেশি ভাইরাসের ছড়াছড়ি। তত বেশি মানুষ যেমন আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা তেমনি বাড়বে মৃত্যুর সম্ভাবনা। বেঁচে থাকলে আল্লাহর কাছে তওবা করতে পারবেন। বেঁচে থাকলে অর্থবিত্ত করতে পারবেন। এই মহাদুর্যোগ সামনে রেখে অনেকে পণ্যের দাম বাড়াচ্ছেন। কত বড় নির্দয় মুনাফাখোর অমানুষ ছাড়া এমন অপরাধ সম্ভব নয়। এ মুহূর্তে বিয়ের অনুষ্ঠান, সভা-সেমিনার, সামাজিক, পারিবারিক, রাজনৈতিক নানা কর্মসূচি বাতিল করা অনিবার্য হয়ে পড়েছে। সর্বত্র লোকসমাগম নিষিদ্ধ করতে হবে।

চট্টগ্রাম পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত মহানগর পুলিশ বন্ধ করে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কক্সবাজার, কুয়াকাটা বন্ধ করে দেওয়া উচিত। আদালতপাড়ায় নানামুখী মানুষ কিলবিল করে। এ নিয়ে ভাবা দরকার। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশের প্রখ্যাত চিকিৎসক, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও শীর্ষ ব্যবসায়ীদের নিয়ে জাতীয় মহাদুর্যোগ প্রতিরোধ কমিটি গঠন করে আলোচনার ভিত্তিতে জনগণের জীবন রক্ষা ও এ ভাইরাসের ভয়াবহতা মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে। প্রয়োজনে প্রধানমন্ত্রীকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের মতো কোথাও ১০ জনের বেশি সমাগম না করাসহ কঠিন নির্দেশনা জারি করতে হবে।

জনগণকেও বুঝতে হবে আগে জীবন। তারপর এমপি, মন্ত্রী ও রাজনীতি। তাই এমপি-মন্ত্রী-নেতাদের ঘিরে সমাগম ভিড় করমর্দন, কোলাকুলি হারাম করে দিন। বেঁচে থাকলে পৃথিবী ভ্রমণ করতে পারবেন। তাই আপাতত ঘরেই থাকেন। সমুদ্রসৈকত হোক আর যেখানে সেখানে হোক, ইচ্ছামতো দলবেঁধে বেড়াতে যাবেন না। চীনের ভয়াবহতা দেখেছেন। ইতালি ও ইরানের মর্মান্তিক দৃশ্য দেখছেন। আমাদের নিজেদের নিরাপদ থাকার জন্য সতর্ক, সচেতন থাকার কোনো বিকল্প নেই। হাসপাতালগুলোকেও শ্বাসকষ্ট বা নিউমোনিয়া রোগে আক্রান্ত হয়ে কেউ গেলেই বিনা চিকিৎসায় ফিরিয়ে দেবেন না। করোনা শনাক্তের সমন্বয় আইইডিসিআরের সঙ্গে যুক্ত করে দিন।

লেখক : নির্বাহী সম্পাদক, বাংলাদেশ প্রতিদিন।

Print Friendly, PDF & Email