অবাধ সাংবাদিক নিগ্রহ

প্রকাশিতঃ 11:08 am | February 15, 2020

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা:

রাজধানীর নয়াবাজারে পেশাগত দায়িত্ব পালনকালে হামলার শিকার হয়েছেন নিউজ২৪-এর রিপোর্টার ও ক্যামেরাপারসন। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা গেছে, একদল সহিংস তরুণ কীভাবে ভয়ংকরভাবে তাদের গাড়িতে দিন-দুপুর হামলা করেছে, ভাঙচুর করেছে। তাদের সাথে থাকা ক্যামেরাও এই সন্ত্রাসীরা ভেঙে দিয়েছে। গত ১ ফেব্রুয়ারি সিটি করপোরেশন ভোটের দিন মোহাম্মদপুরে এক সাংবাদিককে রক্তাক্ত করা হয়েছে।

যেকোনো ছুতোয় সাংবাদিক পেটানো এখন যেন স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ কাজ করছে সন্ত্রাসীরা, রাজনৈতিক কর্মীরা, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা, এমনকি হাসপাতালের ইন্টার্ন চিকিৎসক ও কর্মচারীরা। নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সময় সাংবাদিক ও চিত্র সাংবাদিকদের ওপর নির্বিচার আক্রমণ করেছিল একদল হেলমেটধারী সন্ত্রাসী এবং তা হয়েছে পুলিশের উপস্থিতিতেই। সে সময় তথ্যমন্ত্রী ছিলেন হাসানুল হক ইনু। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে একটি চিঠি পর্যন্ত দিয়েছিলেন এ বিষয়ে তদন্তের জন্য। কিন্তু কত সময় পেরিয়ে গেল। কিছুই করেনি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

সাংবাদিকদের মার খাওয়া এদেশে নতুন নয়। ভোট এলেই সাংবাদিক নিগ্রহ হবে, দুর্নীতি ও অনিয়মের রিপোর্ট করতে গেলে সাংবাদিককে পেটানো হবে, হাসপাতালে কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যুর খোঁজ নিতে গেলে একশ্রেণির চিকিৎসক-কর্মচারী সহিংস হয়ে উঠবে। রাজনৈতিক কর্মীরা, পুলিশ সুযোগ পেলেই সাংবাদিক পিটিয়ে হাতের ব্যায়াম করবে, এটাই যেন রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।

গত বৃহস্পতিবার তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট সেন্টারের নেতাদের বলেছেন, সাংবাদিকদের ওপর হামলা আর বরদাশত করা হবে না। মন্ত্রীকে ধন্যবাদ দেই, কিন্তু এও জানি এটুকুই। আবার হামলা হবে, আবার সবাই বলবে, দোষীদের গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে, বলা হবে এটা গণতন্ত্রের ওপর আক্রমণ ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হবে না।

সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার তদন্ত কীভাবে পথ হারিয়েছে সেটা দেশবাসী দেখেছে। দক্ষিণাঞ্চলে বিএনপি-জামায়াত জামানায় একের পর এক সাংবাদিক খুন হয়েছেন, বিচার হয়নি। সাংবাদিক মারলে কিছু হয় না, এমন একটা ধারণা সমাজবিরোধী চক্রের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। অপরাধী ও দুর্নীতিবাজরা নিজেদের অপকর্মের খবর চাপা দেয়ার জন্য সাংবাদিকদের আক্রমণ করে। যারা কোনো না কোনোভাবে অনৈতিকতা ও অপরাধের সঙ্গে যুক্ত তারাই সংবাদমাধ্যমকে ভয় পায়। নিজ অপকর্মের সংবাদ প্রকাশ হয়ে পড়ার আশঙ্কা থেকেই তারা গণমাধ্যমের গলা টিপে ধরতে চায়, সাংবাদিকদের ওপর আক্রমণ চালায়।

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি আক্রমণের শিকার হন ঢাকার বাইরের সাংবাদিকরা। সেখানে চোরাকারবারি, মাদক ব্যবসায়ী, সরকারি প্রশাসন এবং ক্ষমতাসীন রাজনীতিবিদ- সবাই সাংবাদিকদের প্রতিপক্ষ। কোনো ঘটনার প্রতিকার তো হয়-ই না, তদুপরি একজন সাংবাদিক তার পেশাগত কারণে যখন কোনো প্রতিকূলতার মাঝে পড়েন তখন তার নিয়োগকারী সংবাদমাধ্যমও তাকে সহায়তার জন্য সেভাবে এগিয়ে আসে না। এমনকি তার পেশার বন্ধুরা, বিশেষ করে সাংবাদিক ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সংগঠন কখনও কখনও একটা বিবৃতি দিতেও রাজি হয় না। রাজনৈতিকভাবে বিভাজিত হওয়ায় সাংবাদিক সমাজ তার দৃঢ়তা অনেক আগেই হারিয়ে বসে আছে। কোনো ঘটনায়ই প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারছে না।

গত প্রায় দুই দশকে বাংলাদেশে টেলিভিশন, পত্রিকা এবং অনলাইনের সংখ্যা ব্যাপকভাবে বাড়লেও সাংবাদিকদের স্বার্থ ক্রমেই সংকুচিত হচ্ছে। শিগগিরই পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন হবে- এমন আশাও করেছন না সাংবাদিকরা। একদিকে পেশায় ক্যারিয়ার সংকট, অন্যদিকে এমন নিগ্রহের মুখে পড়ে মেধাবী, তরুণ সাংবাদিকরা ক্রমেই হতাশ হয়ে এ পেশা ছেড়ে দিচ্ছেন।

ইউনিয়ন যেহেতু বিভক্ত, তাই সম্পাদক পরিষদসহ আরও যেসব সংগঠন আছে তারা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে ভাববেন বলে আশা করছি। বিচার চেয়ে যেহেতু বিচার পাওয়া যায় না, তাই সাংবাদিকদের এখন নিজস্ব কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের সাংবাদিকরা হয়তো লেখার প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন, কিন্তু কীভাবে নিরাপদ থাকতে হবে, পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করতে হবে এবং কীভাবে ঝুঁকি এড়িয়ে চলতে হবে, সে প্রশিক্ষণ নিতে হবে।

এই নিরাপত্তা শুধু শারীরিক নয়, দুর্যোগ ও স্বাস্থ্যগত নিরাপত্তা, ডিজিটাল নিরাপত্তা ও আইনি বিষয়ও হতে পারে। আমাদের অ্যাসাইনমেন্ট বিতরণের আগে ঝুঁকি নিরূপণের কোনো ব্যবস্থা নেই গণমাধ্যম অফিসগুলোতে। ঝুঁকিতে পড়লে কীভাবে সেই অবস্থা থেকে সাংবাদিক বেরিয়ে আসবেন, সে বিষয়ে কোনো প্রশিক্ষণ নেই। আমরা ভাবি, সাংবাদিকের নিরাপত্তা মানে রিপোর্টার আর ক্যামেরাপারসনের জন্য বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট আর হেলমেটের ব্যবস্থা করা। কিন্তু নিরাপত্তা নিছক উপকরণের ওপর নির্ভর করে না, করে সঠিক প্রশিক্ষণের ওপর।

প্রশিক্ষণ প্রয়োজন আমাদের। কিন্তু রাষ্ট্রকে তো উদ্যোগী হতেই হবে আমাদের নিরাপদ করতে।

লেখক: প্রধান সম্পাদক, জিটিভি

Print Friendly, PDF & Email