বছর ঘুরে দিবস উদযাপিত হয় কিন্তু শ্রমিকরা থাকে প্রবঞ্চনাময় অতীত ইতিহাসে

প্রকাশিতঃ 11:07 am | May 01, 2018

:: শফী আহমেদ ::

১ মে আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই শ্রমিকদের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে বিজয়ের এক দিবস হিসেবে দিনটি উদযাপিত হয়। আমাদের দেশেও কখনো আন্দোলন, কখনো উৎসবের মধ্য দিয়ে দিবসটি পালিত হয়। কিন্তু মে দিবস চলে যাওয়ার পরই শ্রমিকরা তাদের পূর্বতন অবস্থায় চলে যায়, বছর যায় বছর ঘুরে, দিবসটি উদযাপিত হয় কিন্তু শ্রমিকরা থেকে যায় তাদের প্রবঞ্চনাময় অতীতের ইতিহাসে।

মে দিবসের ইতিহাস শ্রমিকদের প্রতিবাদী সমাবেশে পুলিশের গুলিবর্ষণে ছয়জন শ্রমিকের ঘটনাস্থলে জীবনদানের ইতিহাস। দৈনিক আট ঘণ্টা শ্রমসময়ের দাবিতে ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধি ও কাজের উন্নততর পরিবেশ তথা শ্রমিকের জীবনমান উন্নয়নসহ অন্যান্য দাবিতে আমেরিকার শিকাগোতে শ্রমিকরা অবস্থান ধর্মঘটের ডাক দেয়। মালিক পক্ষের ভাড়াটে লোকজন সেখানে বোমার বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে উভয়পক্ষে হতাহতের ঘটনা ঘটে। আগস্ট স্পাইস নামক এক শ্রমিক নেতাকে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। কিন্তু শ্রমিকদের আন্দোলন থেমে থাকেনি। শ্রমিকরা আন্দোলনে বিজয়ী হয় এবং শহীদের রক্তের বিনিময়ে তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে পৃথিবীতে মে দিবস আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হচ্ছে। সোভিয়েত ব্লকভুক্ত সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহের সমাজতান্ত্রিক সরকারের পতনের আগ পর্যন্ত ব্যাপকভাবে পালিত হয়। ঠিক একইভাবে পুঁজিবাদী দেশসমূহেও পালিত হয় অধিকার আদায়ের আন্দোলনের শপথ।

আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার পূর্ববর্তী সময়ে শ্রমিক আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে মূলত বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ছয় দফার পরিপ্রেক্ষিতে। দেশের মানুষের শোষণ মুক্তির আন্দোলন, শ্রমিকের অধিকার আদায়ের আন্দোলন ও স্বাধিকারের আন্দোলন মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়। নারায়ণগঞ্জের আদমজীতে ও তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলে এই আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। ৬ জুন শহীম মনু মিয়ার আত্মদানের মধ্য দিয়ে তৎকালীন শ্রমিক আন্দোলন বাঙালির স্বাধিকার আন্দোলনের মূল ধারার সূচনা করে।

স্বাধীনতা পরবর্তী সময়েও বাংলাদেশের প্রত্যেকটি রাজনৈতিক দলের শক্তিশালী শ্রমিক সংগঠন ছিল। মূলত ট্রেড ইউনিয়নভিত্তিক দাবি দাওয়া নিয়ে শ্রমিক সংগঠনগুলি আন্দোলন করলেও পরবর্তীতে সকল আন্দোলন মূল রাজনৈতিক আন্দোলনের সাথে একাত্ম হয়ে যায়। ১৯৭৫ সনে বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে হত্যার পর সামরিক শাসন জারি হলে শ্রমিকরাই প্রাথমিকভাবে প্রথম সংগঠিত হয়। এরপর আসে এরশাদের সামরিক শাসন। শ্রমিক সংগঠনগুলি শ্রমিক কর্মচারী ঐক্য পরিষদের ব্যানারে যৌথ মোর্চা গড়ে তোলে। ছাত্র আন্দোলন ও শ্রমিক আন্দোলন পাশাপাশি এগিয়ে চলে। রাজনৈতিক দলসমূহের আন্দোলন যখনই মুখ থুবড়ে পড়েছে তখনই হয় শ্রমিক আন্দোলন, না হয় ছাত্র আন্দোলন রাজপথের শূন্যতা পূরণ করেছে। সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলনে শ্রমিক নেতা তাজুল ইসলামসহ অনেক শ্রমিক আত্মাহুতি দিয়েছেন।

স্বৈরাচারের পতনের পর তেমন কোন শ্রমিক আন্দোলন আর দানা বেঁধে উঠেনি। ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ও আই এম এফ-এর সুপারিশে বেগম খালেদা জিয়া সরকার আদমজীসহ অন্যান্য শিল্প প্রতিষ্ঠান বেসরকারিকরণের নামে বন্ধ করে দেয়। বাংলাদেশে এখন আর শ্রমিকদের সংগঠিত শিল্পাঞ্চল বাস্তবে অবস্থান করে না। একমাত্র গার্মেন্টস সেক্টরের শ্রমিকরা তাদের অধিকারের দাবিতে মাঝে মাঝে সোচ্চার হয়। গার্মেন্টস শ্রমিকরা যে কতটুকু অসহায় তা বোঝার জন্যে খুব বেশিদূর যাওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। স্পেকট্রাম ও রানা প্লাজার দুর্ঘটনায় কয়েক হাজার শ্রমিক ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান। শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয় কিন্তু মূল্যস্ফীতি ও দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে বর্ধিত বেতন কোন সুফল বয়ে আনে না। শ্রমিকদের আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত ৮ ঘণ্টার কর্মসময় কখনোই মানা হয় না। ওভার টাইম সব সময়েই অকার্যকর থাকে। এছাড়াও অন্যন্য শ্রমিক যেমন-আবাসন খাত, পরিবহন খাত ও নৌযান শ্রমিকদের বেলায় কোন নিয়মই কার্যকর নয়। বিশেষ করে নারী শ্রমিকরা বেশি অবহেলার শিকার হন। আইনত নারী শ্রমিকরা মাতৃত্বকালীন ছুটি ও অন্যান্য কিছু সুযোগ সুবিধার অংশীদার হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয় না।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গন বর্তমানে যে অবস্থানে আছে তাতে সহসা শ্রমিকদের জীবনমান উন্নয়নের সুযোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। সামরিক শাসকদের আমলে ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনকে দালাল বেনিয়াদের দিয়ে কলুষিত করা হয়েছে। বিশেষ করে ব্যাংক, বীমা ও অন্যান্য অফিস আদালতে ট্রেড ইউনিয়নের নামে এক ধরনের নৈরাজ্যকর পরিবেশের সৃষ্টি করা হয়েছিল এখন আর সে অবস্থা বিরাজ করে না কিন্তু তবুও কোন কোন সরকারি প্রতিষ্ঠানে ট্রেড ইউনিয়ন নেতারা কর্তৃপক্ষকে বেআইনি চাপ প্রয়োগে নানা কাজ করিয়ে নেয়ায় বাধ্য করে।

এবারের মে দিবসে আমাদের দাবি হোক শ্রমিকদের আন্তর্জাতিক আইনানুযায়ী স্বীকৃত অধিকারসমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত হোক। শুধু কথার ফুলঝুড়ি নয়, বাস্তবে উন্নত বিশ্বের মতো শ্রমিকরা যেন তাদের শ্রম ও আত্মমর্যাদার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারে। আর যেন রানা প্লাজা বা স্পেকট্রাম-এর মতো লোভীমানবসৃষ্ট দানবের দ্বারা শ্রমিকদের জীবন বিপন্ন না হয়। শ্রমিকরা যেন তাদের অধিকার আদায়ের আন্দোলনের লাল ঝাণ্ডা উর্ধ্বে তুলে ধরতে পারে। শ্রমিকরাও যেন মনে করতে পারে ‘আমিই এদেশের উন্নয়নের কারিগর, আমার শ্রম-ঘামেই দেশ এগিয়ে চলেছে।

মহান মে দিবস আমাদের শ্রেণি বৈষম্যহীন সমাজ গড়ে তুলতে অনুপ্রাণিত করে। আমাদের মনে করিয়ে দেয়, শ্রমিক-মজুরের সঙ্গে সমাজের ধনবান বা পুঁজিপতিদের যে ব্যবধান আছে তা কমিয়ে আনা প্রয়োজন। কারণ এই শ্রমিকের শ্রম-ঘামে উন্নয়নের মহাসড়কে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বের সরকার যখন ক্ষমতায় থাকে, তখন দেশের আপামর মানুষের অধিকার বাস্তবায়িত হয়। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্যোগ নিয়ে ছিলেন বলেই, পোশাক শ্রমিকদের মজুরি আজ বেড়েছে। দিনের পর দিন তাদের যেভাবে শোসন করা হতো, তা অনেকটাই বন্ধ হয়েছে। তবে এখনো এসব বিষয়ে আজও সচেষ্ট হতে হবে। সরকার পোশাক শ্রমিকসহ অন্যদের জন্য নূন্যতম যে পারিশ্রমিক নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা যথাযথ মানা হচ্ছে কি না তা দেখতে হবে। মহান শ্রম দিবসের এই ক্ষণে শ্রমিকদের অধিকার শতভাগ বাস্তবায়নের প্রত্যাশা করছি।

লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা

কালের আলো/ওএইচ

Print Friendly, PDF & Email