মাঠে মাঠে কৃষকের ব্যস্ততা

প্রকাশিতঃ 12:10 pm | April 17, 2018

বিশেষ প্রতিবেদক, কালের আলো:

মাঠজুড়ে বাতাসে দোল খাচ্ছে সোনারাঙা ধান। স্বপ্নের বোরো ফসল ঘরে তুলতে মাঠে মাঠে চলছে কৃষকের ব্যস্ততা। ব্যতিক্রম নন স্থানীয় অবস্থাসম্পনন কৃষক নূর হোসেনও (৪৫)। তবে ধানে ভরা ফসলের মাঠ তাঁর একার পক্ষে সামলানো কঠিন।

ফলে ধান কাটা, মাড়াই আর রোদে শুকানো পর্যন্ত বিস্তর কর্মযজ্ঞ সম্পন্ন করতে মাসখানেকের চুক্তি করেছেন নেত্রকোণার সুসং দুর্গাপুরের ভূমিহীন ক্ষেত মজুর খায়রুল মিয়া (৪০), তোতা মিয়া (৫৫), রুবেল মিয়া (২৫) ও হযরত আলীদের (৩৫) সঙ্গে।

ময়মনসিংহ সদর উপজেলার কাতলাসেন চরপাড়া গ্রামে ঠাটা রোদ মাথায় নিয়ে নিবিষ্টমনে নূর হোসেনের ক্ষেতে চুক্তিভিত্তিক ধান কাটার কাজ করছেন এ মজুররা।

বাঙালির ঐতিহ্যের অহংকার বাংলা নববর্ষ উদযাপনে সবাই আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে ওঠলেও খায়রুল, রুবেল বা তোতা মিয়াদের মতো ক্ষেত মজুরদের জীবনে নতুন সূর্যের আলতো ছোঁয়া কোন প্রভাবই ফেলেনি। তাদের জীবনে আসেনি বর্ষবরণের আনন্দ!

নতুন বছরের নতুন দিনটি তাদের কাছে ছিল অন্যান্য দিনের মতোই সাধারণ। এ নিয়ে তাদের সংগ্রামী জীবনেও ছিল না বিশেষ কোন আয়োজন। প্রতিদিনের মতো পহেলা বৈশাখের উৎসবমুখর দিনটিও তাদের কেটেছে পরের জমিতে ধান কেটে, মজুর হিসেবে খেটে।
চৈত্রের কড়া রোদে ফসলের মাঠেই কথা হচ্ছিল তাদের সঙ্গে। তবে এ ক্ষেত মজুরদের জীবনেও রয়েছে পহেলা বৈশাখের সুখ স্মৃতি।

এ স্মৃতি হাতড়ে বয়োবৃদ্ধ তোতা মিয়া (৫৫) বলছিলেন, ‘অভাব-অনটনের সংসারে বেড়ে ওঠলেও বৈশাখ করতে বাবা টাকা দিতেন। সেই টাকা নিয়ে সবার সঙ্গে মেলায় যেতাম। মুড়ি-মুড়কি, বাতাসা কিনতাম। সারা দিন আনন্দেই ঘুরে বেড়াতাম। এখন তো সেই আনন্দ নেই। এখন মানুষের জমিতে কামলার (মজুর) কাজ করতে হয়।’

দারিদ্রতার স্পষ্ট ছাপ খায়রুল মিয়ার মুখেও। প্রতিদিন ধান কেটে তাঁর পকেটে ওঠবে ৪’শ টাকা। মাস শেষে নগদ এ টাকার পাশাপাশি পাবেন ১৫ থেকে ২০ মণ ধান। আর এ ধান নিয়ে ফিরে যাবেন বাড়িতে। এতেই চলবে তাঁর ৪ সদস্যের পরিবারের আহার।

খায়রুল জানান, ছোটবেলায় বৈশাখ এলেই মনে আনন্দের রঙ লাগতো। বাবা-চাচাদের কাছ থেকে ২০ থেকে ৫০ টাকা নিয়ে মেলায় ছুট দিতেন। পান্তা ভাতের সঙ্গে চেঁপা ভর্তা খেতেন। দুপুরে হরেক রকমের শাক রান্না করতেন।’

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে খায়রুল বলেন, ‘এইবার তো দেশের বাড়িত যাওয়া হয় নাই। ধান কাইটাই কুল পাই না।’ তবে নিজের দু’সন্তানের জন্য বিকাশে ঠিকই পহেলা বৈশাখে নতুন জামা কেনা আর মেলার যাওয়ার খরচ পাঠিয়েছেন, জানান এ দরিদ্র মজুর।

গ্রামীণ জীবনে বোরো ধান কাটার এ ভরা মৌসুমে পহেলা বৈশাখে রঙের আভা ছড়ানো তারুণ্যের জোয়ারে নাচে-গানে-বাদ্যের সঙ্গে অবহেলিত গ্রামগুলোর সঙ্গে কোন যোগাযোগই স্থাপন করতে পারেনি। ফলে প্রাণের নববর্ষ তাদের জীবনকে রাঙিয়ে দেয়নি। তবে বিস্তীর্ণ ফসলি জমিতে উপচেপড়া ধানের দৃশ্যে ঠিকই আন্দোলিত হয়ে ওঠে কৃষকের মন।

পহেলা বৈশাখ উদযাপনের চেয়ে ঘাম ঝরানো স্বপ্নের ফসল নিয়েই নিজের ব্যস্ততার কথা জানালেন স্থানীয় অবস্থাসম্পন্ন কৃষক নূর হোসেন (৪৫)। তিনি বলেন, পহেলা বৈশাখেও প্রতিদিনের মতো দিনের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গেই মাঠে এসেছি। ক্ষেত কামলাদের (শ্রমিক) নিয়ে ধান কেটেছি।’

তবে স্ত্রী-সন্তানের বায়না আছে অন্তত বিকেলে পাশের গ্রামে মেলায় নিয়ে যাওয়ার। সেই বায়না পূরণ করেছি। মাটির হাড়ি-পাতিল, হাতি-ঘোড়া ও খাবার সামগ্রী কিনে দিয়েছি ওদের।’

স্থানীয় কাতলাসেন চরপাড়া গ্রামের বিস্তীর্ণ ফসলি জমির যেদিকে চোখ যায় শুধু ধান আর ধান। চারিদিকে চলছে ধান কাটার মহোৎসব। কৃষক আর কৃষাণীর এ কারণে দম ফেলারও যেন ফুরসত নেই।

দিনমান ধান কাটা ও মাড়াই নিয়ে ব্যস্ততা থাকলেও সাত সকালেই শুকনো মরিচের সঙ্গে লবণ চটকিয়ে পান্তা ভাত খাওয়ার রেওয়াজটা আবার ঠিকই ধরে রেখেছেন একই গ্রামের স্থানীয় কৃষক শামসুদ্দিন (৫০)। তিনি বলেন, ফসলের মাঠেই পহেলা বৈশাখের দিন সবাইকে নিয়ে দুপুরে পাট শাক দিয়ে ভাত খেয়েছি। আমাদের মতো গরিবের জন্য এমন আনন্দই কম কিসে!’

 

কালের আলো/আরএসআর/ওএইচ

Print Friendly, PDF & Email