নতুন আইনে সড়কে কতোটা শৃঙ্খলা ফিরবে?

প্রকাশিতঃ 10:16 am | November 12, 2019

শান্তনু চৌধুরী ::

কোনো ধরনের প্রচার প্রচারণা ছাড়াই নভেম্বরের প্রথম দিন থেকে কার্যকর হলো নতুন সড়ক পরিবহন আইন। সড়ক সংশ্লিষ্টরা বিষয়টিকে মন্দের ভালো বা কেউ কেউ স্বাগত জানিয়েছেন। আইনকে স্বাগত জানানো, যদি সেটা নাগরিকের স্বার্থের কথা বিবেচনা করে করা হয় তবে ভালোই। কিন্তু ‘শিব ঠাকুরের এই দেশে আইন কানুন যতোই সর্বনেশে’ হোক না কেনো তার প্রয়োগ নিয়েই কিছু কিছু ক্ষেত্রে বরাবরই সমস্যা হয়। বিশেষ করে সড়ক পরিবহন খাতের মতো জায়গায়, যেটা নির্দিষ্ট কিছু সিন্ডিকেটের হাতে জিম্মি বলে বারবারই শোনা যায়। কিন্তু মুশকিলটা হলো এই সিন্ডিকেট থেকে সাধারণ যাত্রীরা কোনো সময়ই মুক্তি পায়নি, এর ফলে এমন একটা বিশ্বাস জন্মেছে যে, সরকারের চেয়ে সিন্ডিকেটের হাত লম্বা কি না! যার কারণে বিভিন্ন সময়ে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে নানা উদ্যোগ নেয়া হলেও তা ভেস্তে গেছে। সড়ক গাড়ি চালক বা হেলপারই রাজা, যাত্রীদের তারা থোড়াই কেয়ার করেন।

নতুন সড়ক পরিবহন আইন নিয়ে শুরুতে জটিলতা সৃষ্টি হয়। জটিলতা এই কারণে যে, এই আইনটি সম্পর্কে সাধারণ মানুষ যেমন জানতেন না, তেমনি জানতেন না গাড়ি চালকরাও। অনেক অনেক গাড়িচালক টিভি ক্যামেরার সামনে এমনও বলেছেন, যদি তাদের বিভিন্ন সেক্টরে চাঁদা দিতে না হতো বা রাস্তাঘাট ঠিক থাকতো তাহলে সড়ক দুর্ঘটনা রোধ বা সড়কে শৃঙ্খলা অনেকটাই ফিরে আসতো। আইনের যে বিধানগুলো রয়েছে সেগুলোর কয়েকটি বিষয় এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে। সড়কে গাড়ি চালিয়ে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে হত্যা করলে ধারা ৩০২ অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালালে বা প্রতিযোগিতা করার ফলে দুর্ঘটনা ঘটলে তিন বছরের কারাদণ্ড অথবা তিন লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে।

ড্রাইভিং লাইসেন্স ছাড়া মোটরযান বা গণপরিবহন চালানোর দায়ে ছয় মাসের জেল বা ২৫ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড দেয়া হয়েছে। ট্রাফিক সংকেত মেনে না চললে এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। সঠিক স্থানে মোটর যান পার্কিং না করলে বা নির্ধারিত স্থানে যাত্রী বা পণ্য ওঠানামা না করলে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা করা হবে। গাড়ি চালানোর সময় মোবাইল ফোনে কথা বললে এক মাসের কারাদণ্ড এবং ২৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে, গণ পরিবহনে নির্ধারিত ভাড়ার চাইতে অতিরিক্ত ভাড়া, দাবি বা আদায় করলে এক মাসের কারাদণ্ড বা ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা হবে। আইন অনুযায়ী ড্রাইভিং লাইসেন্সে পেতে হলে চালককে অষ্টম শ্রেণি পাস এবং চালকের সহকারিকে পঞ্চম শ্রেণি পাস হতে হবে হবে। আগে শিক্ষাগত যোগ্যতার প্রয়োজন ছিল না। গাড়ি চালানোর জন্য বয়স অন্তত ১৮ বছর হতে হবে। এই বিধান আগেও ছিল।

এখন এই আইন চালু হলেও প্রয়োগ করতে গিয়ে শুরু থেকে জটিলতা সৃষ্টি হয়। ট্রাফিক পুলিশের সফটওয়্যার আপডেট না করায় নতুন হারে জরিমানা আদায় করা যায়নি এক নভেম্বর থেকে, তৈরি হয়নি আইনের প্রয়োজনীয় বিধিমালাও। ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে তাই শুরুতে যে কাজটি করা হচ্ছে তা হলো এক সপ্তাহ সচেতনতা সৃষ্টি করা। বিভিন্ন স্থানে ট্রাফিক পুলিশের পক্ষ থেকে সচেতনতা মূলক লিফলেটও বিতরণ করা হচ্ছে। এতে চালক ও হেলপারদের নির্ধারিত বাস স্টপেজে বাস থামানো, চলন্ত অবস্থায় বাসের দরজা বন্ধ রাখা, ঘুমঘুম চোখে গাড়ি না চালানো, ড্রাইভিং লাইসেন্স ব্যতিত গাড়ি না চালানো, গাড়ি চালানোর আগে গাড়ির অন্যান্য কাগজপত্র সঠিক আছে কিনা তা দেখে নেয়া, মহাসড়কে দ্রুতগতিতে গাড়ি না চালানো ও পথচারীদের রাস্তা পারাপারে (ফুটওভারব্রিজ, জেব্রা ক্রসিং ব্যবহার) ইত্যাদি বিষয় মেনে চলার জন্য চালক, হেলপার ও পথচারীদের আহ্বান জানান হয়েছে। এক সপ্তাহ মানে নভেম্বরের দ্বিতীয় সপ্তাহের শেষ থেকে শুরু হবে অ্যাকশন। আইনটি কঠোর হয়েছে সন্দেহ নেই কিন্তু এই আইন দিয়ে সড়কে কতোটা শৃঙ্খলা ফিরবে তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ রয়ে গেছে।

আইন কার্যকর ঠিকমতো করা হচ্ছে কিনা সেজন্য সার্জেন্টের পোশাকে ক্যামেরা লাগানো থাকবে বলে জানিয়েছেন ডিএমপি কমিশনার। সেটি বন্ধ থাকলে বুঝে নেয়া হবে,‘অবৈধ কাজের জন্য ক্যামেরা বন্ধ ছিল’। এই ব্যবস্থাটি আগেও ছিল কিন্তু কিছুদিন প্রয়োগের পর তা মুখ থুবড়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, বাংলাদেশে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রতিদিন গড়ে ৫৫জন মারা যান। আর বাংলাদেশ রিসার্চ ইন্সটিটিউটের গবেষণা বলছে, দেশে প্রতি বছর সড়ক দুর্ঘটনায় গড়ে ১২ হাজার মানুষ নিহত ও ৩৫ হাজার আহত হন। এমন প্রেক্ষাপটে গত বছর বাসের চাপায় দুই স্কুল শিক্ষার্থীর মৃত্যুর পর ঢাকায় শুরু হয় শিক্ষার্থীদের নজিরবিহীন আন্দোলন। এরপর শাস্তির বিধান কঠোর করে সড়ক পরিবহন আইন, ২০১৮ প্রণয়ন করে সরকার। ১ নভেম্বর থকে তা কার্যকরের জন্য ২২ অক্টোবর প্রজ্ঞাপন জারি হয়। সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ আইনে চালকেরা উদ্বেগ উৎকণ্ঠার কথা জানালেও নতুন সড়ক পরিবহন আইনের জেরে যানবাহনের মালিক-চালকদের উপচে পড়া ভিড় দেখা গেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) এর কার্যালয়ে। তবে সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানোর নামে পরিবহন শ্রমিকদের বিরুদ্ধে শাস্তি বাড়ানোর বিরোধিতা করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যকরী সভাপতি ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খান। বিরোধিতা করেছে আরো কয়েকটি সংগঠন।

আমাদের এখানে যেটা হয়, প্রতিদিন সড়ক দুর্ঘটনায় মানুষ মারা যাচ্ছে কিন্তু কোনো পরিবর্তন চোখে পড়ে না। গাড়িগুলোর চালকরা কে কার আগে যাবে তা নিয়ে প্রতিযোগিতা কমছে না। এর জন্য কোম্পানির অধীনে বাস চালানো এবং দৈনিক চুক্তি বাদ দিয়ে বাস চালানোর কথা বলা হলেও তা কার্যকর হয়নি। আবার পথচারীরাও ইচ্ছামতো হাত দেখিয়েই দ্রæত গতির গাড়ি থামিয়ে রাস্তা পার হয়ে যাচ্ছে। নতুন আইনে শাস্তি বাড়ানোর কারণে মানুষ হয়তো ভয় পাবেন, সাবধান হবেন। আবার আইন বাস্তবায়নে পুলিশকে যথাযথ ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের আরো বেশি তৎপর হতে হবে। যারা বাইরে যান তারা নিশ্চয় জানেন, সেখানে এতো গাড়ি, এতো মানুষ হলেও আইন ভাঙার প্রয়োজন পড়ে না। এমনকি আমাদের দেশ থেকেও যারা সেখানে যান সেটা দীর্ঘমেয়াদে থাকা বা বেড়াতে যাওয়া যেটাই হোক না কেনো তারা কিন্তু আইন মেনেই চলেন। কারণ সেখানের আইন যেমন কড়া তেমনি তার প্রয়োগও কড়া। এখন আমাদের দেশে সমস্যাটা হলো, ট্রাফিক পুলিশ যে ঘুষ নেন সেটা ওপেন সিক্রেট।

অনেকে বলছেন, এখন জরিমানা বাড়ায় তারা আগে যেখানে দুশো টাকা ঘুষ নিয়ে ছেড়ে দিতো এখন সেখানে পাঁচশ টাকা দিতে হবে, নইলে বলবে পাঁচ হাজার টাকার মামলা দিচ্ছি। আরেকটি বিষয় বলা হচ্ছে, অবৈধ পাকিং। আমাদের দেশে স্কুল, কলেজ, হাসপাতালের কোথাও প্রয়োজনীয় পার্কিং এর ব্যবস্থা নেই। যা রয়েছে তা অত্যন্ত সীমিত। এমনকি প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র বলে পরিচিত সচিবালয়ে যতোগুলো গাড়ি প্রবেশ করে সেখানেও নেই প্রয়োজনীয় পার্কিং। তাহলে এসব সমস্যার সমাধান না করে জরিমানা করলে সেটা কতোটা ভালো হবে বলা মুশকিল। আবার যারা প্রাইভেট গাড়ি চালান তাদের ওপর মালিকদের একটা চাপ থাকে পার্কিং এর। আর চালককে যে বেতন দেয়া হয় তার থেকে যদি জরিমানার টাকা কেটে নেয়া হয় তারতো ঢাকা শহরের মতো জায়গায় খেয়ে পরে বেঁচে থাকতে পারবে না।

গণপরিবহনের নৈরাজ্য ঠেকাতে সংবাদমাধ্যমগুলো থেকে শুরু করে বিভিন্ন মাধ্যমে বারবার বলা হলেও যেই লাউ সেউ কদু। ইচ্ছেমতো ভাড়া আর চালক হেলপারদের কাছে জিম্মির ঘটনাতো রয়েছেই। কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে বিভিন্ন সময়ে তাদের হাতে শারীরিকভাবে লাঞ্ছিত হয়েছেন সংবাদকর্মীসহ অনেকে। বয়সসীমা আগেও বেঁধে দেয়া হয়েছে কিন্তু কেউ মানেনি। বিশেষ করে লেগুনাগুলো চালায় অল্পবয়সী চালক। সার্টিফিকেট বেঁধে দিয়েছে ভালো, কিন্তু এর মাধ্যমে স্কুলগুলোর একটা ব্যবসা করার পরিবেশ তৈরি হলো। টাকা দিলে পঞ্চম বা অষ্টম শ্রেণির সার্টিফিকেট জোগাড় করতে বিশেষ বেগ পেতে হবে না। তাছাড়া নীলক্ষেততো রয়েছেই। সবশেষে যে কথাটা বলা দরকার সড়ক পরিবহন আইন বাস্তবায়ন করতে গেলে আগে অবকাঠামোগত উন্নয়নটা জরুরি।

এই যেমন এখন মিরপুর থেকে শুরু করে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পের কাজ চলছে, সেখানে পথচারী পারাপার বা গাড়িা চলাচল করাই দায় সেখানে আইন মেনে কতোটুকু চলা যাবে তা বলাই বাহুল্য। আবার ফুটওভার ব্রিজ দিয়ে চলাচল করতে গিয়ে নানা সমস্যায় পড়তে হয়। একেতো এসব ব্রিজ অনেক সময় নোংরা থাকে, ভিক্ষুকের বসবাস। রাত বাড়লেই চুরি, ছিনতাইয়ের ঘটনাতো রয়েছেই। আবার নির্দিষ্ট জায়গা থেকে বেশ খানিকটা দূরে বলে সেখান দিয়ে পথচারী পারাপার হতে চায় না। বিশেষ করে বয়স্ক নাগরিক বা রোগীরা।

এই যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনের ফুটওভার ব্রিজের কথাই যদি বলি সেটা দিয়ে উঠে হাসপাতালে যাওয়া যে কোনো রোগীর পক্ষেই কষ্টসাধ্য। এটার একটা সমাধান করা উচিত। আবার কোনো কোনো পথচারী সেতুর সিঁড়িগুলো এতো খাঁড়া খাঁড়া যে হাঁপিয়ে উঠতে হয়। সে কারণেও ভয়ে কেউ উঠতে চান না। শেষ কথা এই যে, মানুষের মঙ্গলের জন্য, দেশের উন্নয়নের জন্যই আইন। সেই আইন যাতে সবাই মানে সেটা কাম্য। তবে আইন মানার আগে সেই পরিবেশ সৃষ্টি জরুরি। জোর করে আইন মানাতে গিয়ে সেটা না আবার বুমেরাং হয়ে ওঠে!

লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক।

Print Friendly, PDF & Email