হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে অভিযোগ, হাব সভাপতিকে থামিয়ে দিলেন ধর্মসচিব

প্রকাশিতঃ 12:09 am | October 18, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

এবারের হজ ব্যবস্থাপনা নিয়ে নানা ভুল ও গাফিলতি তুলে ধরায় হজ এজেন্সিস অ্যাসোসিয়েশনের (হাব) সভাপতি শাহাদাত হোসেন তসলিমকে বক্তব্যের মাঝখানে থামিয়ে দিয়েছেন ধর্মসচিব আনিছুর রহমান। হাব সভাপতির বক্তব্যে বিরক্তবোধ করেন তিনি। তার অসন্তুষ্টির কারণে শেষ পর্যন্ত হাব সভাপতিকে আর বক্তব্যই রাখতে দেয়া হয়নি।

বৃহস্পতিবার(১৭ অক্টোবর) ধর্ম প্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহর ‍উপস্থিতিতে দুপুরে রাজধানীর অফিসার্স ক্লাবে হজ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক কর্মশালায় এমন ঘটনা ঘটে।

ধর্মসচিব আনিছুর রহমানের সভাপতিত্বে কর্মশালায় প্রধান অতিথি ছিলেন ধর্মপ্রতিমন্ত্রী শেখ মো. আব্দুল্লাহ। তার উপস্থিতিতে কর্মশালায় এক পর্যায়ে বক্তব্য দিতে আসেন হাব সভাপতি শাহাদাত হোসেন তসলিম।

এ সময় তিনি বলেন, এবার সুন্দর হজ ব্যবস্থাপনা চ্যালেঞ্জ ছিল। আমরা সবাই মিলে সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি। ভবিষ্যতে যাতে এমন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে না হয় সেই কর্মপন্থা নির্ধারণ করেছি। আমি বলব, প্রধানমন্ত্রীর সার্বক্ষণিক তদারকিতে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী, বিমানপ্রতিমন্ত্রী, ধর্মসচিব, এজেন্সি মালিকসহ সবার আন্তরিকতায় এবার সুন্দর ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে পবিত্র হজ পালন সম্পন্ন হয়েছে। তারপরও অনেক ভুলত্রুটি ছিল। সরকারের তদারকিতে অনেক অবহেলা পরিলক্ষিত হয়েছে। এসব সংশোধন করা গেলে আগামীতে আরো সুন্দর, ভাল হজ ব্যবস্থাপনা সম্ভব হবে।

হাব সভাপতি বলেন, সময়মতো টিকিট বিক্রি হওয়ায় এবার বাংলাদেশ পর্বে সুন্দর হজ ব্যবস্থাপনা সম্ভব হয়েছে। তারপরও বলব, একটি এয়ারলাইন্সের মারাত্মক স্বেচ্ছাচারিতায় হজ ব্যবস্থাপনায় সমস্যা সৃষ্টি করেছিল, যদিও আমরা সবাই মিলে সেই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠেছি।

তিনি বলেন, এবারও বিমানের ফ্লাইট বিপর্যয় হয়েছে। আমার প্রশ্ন ডাবল টাকায় কেন কনজাস্ট এয়ারক্রাফট কেনা হলো। তাতে হাজযাত্রীদের ভোগান্তি হয়েছে। অথচ সুবিধা সম্বলিত ভাল ও বড় এয়ারক্রাফট দেয়া যেত।

হাব সভাপতি হজ ব্যবস্থাপনার সৌদি পর্বে হজ যাত্রীদের ভোগান্তি তুলে ধরে বলেন, সৌদি আরব পর্বে হজ গাইডরা সরকারি প্রটোকল ও সরকারি হজযাত্রীদের সেবায় ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু বেসরকারি হজযাত্রীদের সেবাই কাউকে পাওয়া যায় না। তারা অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টে পড়লেও তাদের দেখার কেউ থাকে না। অথচ হজযাত্রী সেটা সরকারি হোক, আর বেসরকারি হোক সবাইকে দেখভাল করার দায়িত্ব ধর্ম মন্ত্রণালয়ের। কারণ তাদের কল্যাণে একটি কল্যাণ ফান্ড রয়েছে। এ ফান্ডের টাকায় সরকারি হজকর্মীরা সরকারি হজযাত্রীদের সেবা করতে যায়। অথচ প্রতি বছর সরকারি হজযাত্রীর পাশাপাশি বেসরকারি হজযাত্রী সবার কাছ থেকে ৩০০ টাকা কেটে রাখা হয়। বেসরকারি হজযাত্রীদের টাকাই এ ফান্ডে বেশি। বলতে গেলে ফান্ডের প্রায় সব টাকাই বেসরকারি হজযাত্রীদের কিন্তু, সৌদি আরবে তাদের সেবার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয় না। তাদের দেখভালে কোনো হজকর্মী নিয়োগ করা হয় না। আমি মনে করি, সরকারি, বেসরকারি বিবেচনা না করে সবাই হজযাত্রী এটি মাথায় রেখে তাদের সেবার জন্য পর্যাপ্ত হজকর্মী নিয়োগ করা উচিত।

হাব সভাপতি বলেন, হারানো হজযাত্রীদের যে দুঃখ কষ্ট চোখে না দেখলে বিশ্বাস হবে না। এবার তাদের সেবায় সরকারের একজন হজকর্মী আমরা পাইনি। হারানো হজযাত্রীদের খুঁজে বের করে পৌঁছানো সরকারের দায়িত্ব, কিন্তু তারা চেষ্টা করলেও সেটা করতে পারে না। বরং হারানো হাজিদের খুঁজে বের করার কাজটি হাবকে করতে হয়েছে। হারানো যাত্রীদের খুঁজে বের করা, তাদের খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করা কঠিন। সেটা সরকারি প্রতিনিধি বলেন, বিজনেস অটোমেশন বলেন, তাদের পক্ষে হারানো হাজিদের খুঁজে বের করা কঠিন। যেটা সহজে হাব করতে পারে। হারানো হজযাত্রীদের তদারকির দায়িত্ব হাবকে দেয়ার অনুরোধ করেন তিনি।

সরকারের পাঠানো চিকিৎসক দলের সমালোচনাও করেন হাব সভাপতি শাহাদাত হোসেন তসলিম। তিনি বলেন, হাজিদের সঠিক চিকিৎসা সেবার জন্য সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক পাঠানো উচিত। এখানে ইসিজি নেই, এক্সরে নেই। কিন্তু রেজিওলজির চিকিৎসক পাঠানো হয়েছে। অথচ প্রেসক্রিপশনের জন্য মেডিসিন, প্যাথলজি, কিংবা সাইকলজি বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দরকার। প্রয়োজনীয়তার কথা চিন্তা না করে সিরিয়ালি মেইনটেইন করে যদি চিকিৎসক দল কিংবা নার্স সহকারীদের পাঠানো হয় তাহলে হজযাত্রীদের চিকিৎসা সেবায় বিঘ্ন ঘটবে বলে আমি মনে করি।

ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করে তসলিম বলেন, ফিরতি ফ্লাইটের টিকিট নিয়ে বড় ধরনের অনিয়ম হচ্ছে। বেশি টাকা নিয়েও ফিরতি ফ্লাইটের টিকিট খালি রাখা হচ্ছে। কিন্তু ফিরতি ফ্লাইটের টিকিট খালি কেন আমি জানতে চাই। এ ফ্লাইট তো করসপন্ডিং ফ্লাইট। অতিরিক্তি টাকা নিয়ে ফিরতি টিকিট খালি রেখে হজযাত্রীদের চরম ভোগান্তিতে ফেলানো হচ্ছে। সুন্দর হজ ব্যবস্থাপনা করতে হলে এটা বন্ধ করতে হবে।

তিনি অভিযোগ করেন, হজযাত্রীদের সেবা নিয়ে সরকারি-বেসরকারি ব্যবস্থাপনা সমান চোখে দেখা হচ্ছে না। অন্যায় করলে এজেন্সিগুলোর শাস্তি হোক, কিন্তু সামান্য ভুলের জন্য অনেক সময় তাদের বড় শাস্তি দেয়া হচ্ছে। অথচ সরকারি হজযাত্রীরা দুঃখ কষ্ট পেলেও তারা অভিযোগ দিতে পারেন না। এজন্য দায়ীদের শাস্তিও হয় না। ‍

হাব সভাপতি বলেন, সামান্য বিদ্যুৎ চলে যাওয়ায় একটি বেসরকারি হজ এজেন্সির লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছে। এক্ষেত্রে তার দোষ ছিল না। অথচ একই সমস্যা এবার হয়েছিল। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ৮ নম্বর বাড়িতে বিদ্যুৎ চলে গিয়েছিল। আমি জানতে চাই তাদের বিরুদ্ধে কি একই ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। এসব বিষয় নিয়ে এজেন্সিগুলোর প্রশ্নে মুখে হাবকে পড়তে হয়। আমরা সদুত্তর দিতে পারি না। তাই নয় দুপুরে একটি হোটেলে গরম পানি আসার কারণে একটি হজ এজেন্সিকে শাস্তি দেয়া হলো। এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে ধর্মসচিব ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে তাকে থামিয়ে দেন। একপর্যায়ে তাকে আর বক্তব্য দিতে দেয়া হয়নি। এ সময় ধর্ম প্রতিমন্ত্রী হস্তক্ষেপ করে বলেন, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে আমি নতুন। যতটুকু পেরেছি চেষ্টা করেছি। ভাল মন্দ, ভুল ত্রুটি থাকতেই পারে। আমরা সবাই মিলে চেষ্টা করেছি সুন্দর হজ ব্যবস্থাপনার জন্য। আশা করি, ভুল ত্রুটি শোধরে সামনে সবার সহযোগিতায় আরো সুন্দর ও ভাল হজ ব্যবস্থাপনা হবে।

কর্মশালায় ধর্মসচিবের এমন আচরণে হাব নেতারা অসন্তুষ্ট হয়েছেন। কর্মশালায় উপস্থিত হজ এজেন্সিগুলোর মালিকরাও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, হাব সভাপতি কারো পক্ষে নয় বিপক্ষে নয়। তিনি সহজ সরল ও নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে হজ ব্যবস্থাপনায় সরকারি, বেসরকারি ভুল ত্রুটি, গাফলতি তুলে ধরেছেন। একইসঙ্গে ভাল পদক্ষেপ এর জন্য, সুন্দর হজ ব্যবস্থাপনার জন্য প্রধানমন্ত্রী, ধর্মপ্রতিমন্ত্রী, ধর্মসচিবসহ সংশ্লিষ্ট সব সর্বোপরি সরকারের প্রশংসা করেছেন। কিন্তু বক্তব্যের মাঝখানে হাব সভাপতিকে এভাবে থামিয়ে দেয়া ঠিক হয়নি। প্রতিমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এমন ঘটনা দৃষ্টিকটু। বরং তার বক্তব্য শুনে পরবর্তীতে ব্যখ্যা দেয়ার সুযোগ ছিল। এতে অনুষ্ঠানের সৌন্দর্য নষ্ট হয়েছে।

পরে হাব সভাপতির উদ্দেশ্যে ধর্মসচিব আনিছুর রহমান বলেন, হাব সভাপতি বিরক্ত হতে পারেন। কর্মশালার প্রথম অধিবেশন সুন্দরভাবে শেষ করতে চেয়েছিলাম। আমি চেয়েছিলাম, পরবর্তী সেশনে এ যাবতীয় কথাবার্তা মন খুলে বলতে। যতকথা আছে বলবেন। আমরা সব ধরনের বক্তব্য, মতামত শুনে তা থেকে স্ক্যান করে নেব।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ পর্ব অত্যন্ত চমৎকার। যা কিছু সমস্যা হয়েছে সৌদি পর্বে। দুর্বলতা নিজেদেরও ছিল। এবার প্রতিমন্ত্রী নিজেই প্রতিদিন সার্বক্ষণিক তদারকি করেছেন। অফিসে বসেছেন। তাৎক্ষণিক সমস্যার সমাধানও করেছেন। আমরা চেষ্টা করেছি এবার হজ ব্যবস্থাপনায় অন্যমাত্রা দিতে। এটা ধরে রেখে আপনাদের মতামত নিয়ে নতুন কিছু যুক্ত করে ব্যবস্থাপনা করা গেলে ২০২০ সালের হজ হবে আরো সুন্দর আরো সুশৃঙ্খল। তিনি সুন্দর হজ ব্যবস্থাপনার জন্য হজের আগে মদিনায় বাড়ি ভাড়া, হজকর্মী বৃদ্ধি, হজ আইন সংসদে নিয়ে যাওয়া, বিশেষ করে হজ প্যাকেজের পুরো টাকা আদায়সহ নানা উদ্যোগের কথা জানান।

কালের আলো/এনআর/এমএম

Print Friendly, PDF & Email