আবরার হত্যা : সত্যের মৃত্যু

প্রকাশিতঃ 9:18 am | October 12, 2019

নাসরীন গীতি ::

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিশেষ করে মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে একটা সন্তানকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পৌঁছাতে কতটা কাঠ-খড় পোড়াতে হয়, এটা কেবল সে পরিবারটাই জানে। কিন্তু সেই সন্তানকেই যখন অন্যের রোষানলে পুড়তে হয়, শেষ পরিণতি মর্মান্তিক হয়, তখন বাবা-মা বা তার স্বজনরা কোন বিশ্বাসে সেই সমাজ বা রাষ্ট্রকে ভরসা করতে পারে!!

বুয়েটের ইলেকট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের দ্বিতীয় বর্য়ের ছাত্র আবরার ফাহাদকে নির্মমভাবে খুন করার ঘটনায় আবারও স্তম্ভিত হলো দেশ। প্রতিবাদে উত্তাল আবরারের প্রতিষ্ঠান বুয়েটসহ, দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। যদিও এর মধ্যেও দেখা যায়, গুটিকয় মানুষ “চাচা আপন প্রাণ বাঁচার মতো” দায়সারা আলাপ দিয়ে ঘটনার গোঁজামিল দিতে ব্যস্ত থাকছেন। আরে ভাই, আবরার তো ক্রমান্বয়ে দেশের সম্পদ হয়ে উঠছিল।

যারা তাকে পিটিয়ে হত্যা করলো, তারাও যে মেধাবী নয়, সে তর্কে যাচ্ছি না। তবে প্রশ্ন জাগে, সর্বোচ্চ একটি বিদ্যাপীঠে যেখানে সব মেধাবী শিক্ষার্থীর স্থান, সেই মেধাবীরা কি বিবেকশূন্য! তারা কি পরিবার থেকে এতটুকু মমত্ববোধ শিখে আসেনি, চারপাশের সমাজ কি শেখায়নি আবেগের পাশাপাশি বিবেক-বোধ-বিবেচনা কাজ করতে হবে তাদের মধ্যে!! নাকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এসে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় বাল্যকালে শেখা সততা, বিচক্ষণতা, চিন্তাশীলতার সেই সদভ্যাসগুলো ক্ষমতার জলে গুলে খেয়ে ফেলেছে।

আবরার হত্যার খবর শোনার মুহূর্তেই চোখে ভেসে উঠলো প্রায় ১৭ বছর আগের সেই ছবি, বুয়েটের আরেক শিক্ষার্থী সাবিকুন্নাহার সনির মুখটি। ২০০২ সালে ছাত্রদলের দুই গ্রুপের টেন্ডারবাজির গোলাগুলিতে পড়ে অকালে প্রাণ দেয় সনি। এত বছর পর আবারও ছাত্র সংগঠনের ছেলেদের হাতেই খুন হলো বুয়েটের মেধাবী ছাত্র আবরার। এবার ঘাতক ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা। যারা পিটিয়ে হত্যা করলো তাকে।

১৭ বছর আগে ও পরে, ঘটনা- ‘খুন’, একই ক্যাম্পাস, শুধু ধরন আলাদা। আর কুশীলবও ভিন্ন চরিত্রের। ছাত্রদল আর ছাত্রলীগ, শুধু ক্ষমতার পালাবদলে পাত্রপাত্রীর পরিবর্তন। কিন্তু প্রাণ যায় সাধারণের। ভুক্তভোগী হয় সেই সাধারণের পরিবারগুলো। যারা জীবন সংগ্রামে সততা আর নিষ্ঠা দিয়ে টিকে থেকে সন্তানের উপর নির্ভরতা তৈরি করেন। যখন তাদেরই সেই নির্ভরতার জায়গাটি যেকোনভাবে শুন্যে মিলিয়ে যায়, তখন সে মানুষগুলোও অথৈ সাগরে হাবুডুবু খেতে থাকে। কেউ ঘূর্ণাবর্তে তলিয়ে যায়, আর কারো জীবন ধুঁকে ধুঁকে চলে।

এই দিন দু’য়েকেই ভাবতে ভাবতে হাঁপিয়ে উঠেছি। কেন এভাবে পিটিয়ে মারতে হলো আবরারকে? ছাত্রলীগের এই ছেলেরাও তো বুয়েটেরই ছাত্র, আবরারেরই সতীর্থ বা বড় ভাই কিংবা ছোট। তাহলে তারা কি মদের দরে বা জলের দরে সস্তায় বিক্রি হলো তথাকথিত ছাত্র রাজনীতির কাছে! আর আশপাশের ছাত্ররাইবা চুপ রইলো কেন, কে তাদের মুখে কুলুপ এঁটে দিলো!! আবরারের প্রাণ যাওয়ার বেদনায় নীল হয়ে এখন যে বিস্ফোরণ, তার নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার আগমুহূর্তের সেই আর্তচিৎকার কি কারো মর্মবেদনা জাগাতে পারেনি!!! এতো অনুভূতিশুন্য মস্তক তুলে তারা দাঁড়ায় কিভাবে!!!!

তাদের তো জানা- অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে- দু’জনই সমান অপরাধে অপরাধী। তারপরও আমি কিছুটা তৃপ্ত যে, এবার জ্বলে উঠেছে বুয়েটের শিক্ষার্থীরা। তারা জাগাতে পেরেছে দেশের ছাত্র সমাজ আর বিভিন্ন মহলকে, যাদের অনুভূতি এখনও মরে যায়নি। যাদের মগজ একটু শান পেলেই ধারালো হয়। আবরারের মৃত্যু তার সহপাঠীদের শিখিয়েছে অন্যায় হলে মুখ গুঁজে বসে না থেকে, দাউ দাউ জ্বলে উঠতে। তাঁর মৃত্যু একটু হলেও নাড়া দিতে পেরেছে এই ঘুণে ধরা সমাজটাকে।

প্রশ্ন তুলতে চাই না, পার পেয়ে যাবে কি আবরারের খুনিরা। বলতে চাই, বিচার হবেই হত্যাকারীদের। যারা ক্ষমতার দম্ভে ভুলে যায় মনুষ্যত্বকে, হারায় বিবেক-বোধ। বলতে চাই, দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, অপরাধ বিবেচনায়ই শাস্তি পাবে অপরাধীরা। কারণ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময়ই বলে আসছেন, অপরাধী যে-ই হোক, তার ছাড় নেই। এরই মধ্যে তার কিছু নজিরও আমরা দেখেছি। তাই বিশ্বাস করতে চাই, এই বিচারটা হবেই। অপরাধীরা সাজা পাবেই। শিক্ষার্থীরা বুঝবে যে, তারা যতবড় ক্ষমতাশালীই হোক না কেন, অন্যায় করলে শাস্তি পাবেই।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক, বাংলাভিশন।

Print Friendly, PDF & Email