শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনার কথা জানতেন সেই ‘পাগলা মিজান’!

প্রকাশিতঃ 10:02 pm | October 11, 2019

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

সামরিক শাসক এইচ এম এরশাদের শাসনামলে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারী কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান ও কর্নেল বজলুর রশীদের নেতৃত্বে ফ্রিডম পার্টি গঠিত হয়েছিল। এ কথিত দলটির প্রাইম টার্গেট ছিলেন বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। টার্গেট বাস্তবায়নে তাঁরাই সশস্ত্র হামলা চালিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের সেই বাসভবনে।

আরও পড়ুন: হলো না শেষ রক্ষা, যেভাবে ধরা পড়লো ‘পাগলা মিজান’

নিরাপত্তারক্ষী হাবিলদার জহিরুল হক ও কনস্টেবল জাকির হোসেন জীবনবাজী রেখে সেই হামলা প্রতিহত করেছিলেন। সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলেন জাতির জনকের রক্তের উত্তরাধিকার। কিন্তু সেদিনের সেই টার্গেট কিলিং মিশনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন ফ্রিডম পার্টির মোহম্মদপুর-ধানমন্ডি থানার সমন্বয়ক মোস্তফিজুর রহমান মোস্তফা।

আরও পড়ুন: কার ‘সোনার ডিমপাড়া হাঁস’ ছিলেন পাগলা মিজান, ‘লাপাত্তা’ আদাবরের তুহিন!

এ মোস্তফারই বড় ভাই মোহাম্মদপুর থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান প্রায় ২০ বছর আগে আদালতকে জানিয়েছিলেন বিস্ফোরক এক তথ্য! নিজের ছোট ভাই ফ্রিডম মোস্তফা হত্যা মামলায় আদালতে স্বাক্ষী দিতে গিয়ে তিনি জবানবন্দিতে বলেছিলেন, ‘আমার ভাই মোস্তফার সঙ্গে আমার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। মোস্তফা কি কাজ করতো কোথায় যেতো এসব বিষয়ে আমার মোটামুটি ধারণা ছিল।’

আরও পড়ুন: ম্যানহোলের ঢাকনা চোর থেকে শত কোটি টাকার মালিক ‘পাগলা মিজান’

তাঁর এ সরল স্বীকারোক্তি থেকেই স্পষ্ট হয়ে উঠে ১৯৮৯ সালে খুনির দল ফ্রিডম পার্টি ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু ভবনে শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে যে পরিকল্পিত সশস্ত্র হামলা করবে সেই বিষয়টি সম্পর্কে আগেই জানতেন তিনি!

খুন, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও মাদক ব্যবসাসহ নানা অপকর্মের অভিযোগে শুক্রবার (১১ অক্টোবর) সকালে মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গলে গুহ রোড এলাকা থেকে র‌্যাবের হাতে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজান গ্রেফতার হওয়ার পর পুনরায় এ বিষয়টি সামনে চলে এসেছে।

আরও পড়ুন: শেখ হাসিনাকে হত্যা চেষ্টাকারীর ভাই কীভাবে অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়েছেন?

রাজধানীর মহানগর দ্বিতীয় অতিরিক্ত দায়রা জজ আদালতে দেওয়া এ জবানবন্দির কপি কালের আলো’র হাতে এসে পৌঁছেছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সুযোগে জার্সি বদল করে এক সময়কার ফ্রিডম পার্টির সক্রিয় নেতা মিজানুর রহমান ওরফে হাবিবুর রহমান মিজান আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে নাম লিখিয়েছেন।

বঙ্গবন্ধুর খুনিদের হাতেগড়া দলের সক্রিয় নেতা এবং বঙ্গবন্ধুর কন্যাকে হত্যাচেষ্টার মিশনে অংশ নেওয়া ফ্রিডম মোস্তফার বড় ভাই কীভাবে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতের পাদপ্রদীপে উঠে আসেন এ নিয়েও রাজ্যের প্রশ্ন তৈরি হয়েছে। তবে বরাবরই ধুরন্ধর এ নব্য আওয়ামী লীগার বঙ্গবন্ধু কন্যাকে হত্যা চেষ্টার সঙ্গে তাঁর কোন সম্পৃক্ততা ছিল না দাবি করে ১৯৮৯-এর ১০ আগস্ট কালো রাতের সেই ঘটনাটি সুকৌশলে পাশ কেটে গেছেন।

আরও পড়ুন: পাগলা মিজান কীভাবে ‘ধনকুবের’, বেরিয়ে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য

সূত্র মতে, দুধর্ষ কিলার ফ্রিডম মোস্তফার আলোচিত-সমালোচিত বড় ভাই হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানের বিস্ময়কর রাজনৈতিক উত্থানের পেছনে আশীর্বাদের ঢাল হিসেবে আবির্ভূত হন ক্ষমতাসীন দলের বিতর্কিত প্রভাবশালী এক রাজনীতিক। মূলত তাঁর অঙ্গুলী হেলনেই ধামাচাপা পড়ে যায় ফ্রিডম পার্টির মোস্তফা ও হাবিবুর রহমান মিজানের ভয়ঙ্কর অতীত ব্যাকগ্রাউন্ড।

জানা যায়, বঙ্গবন্ধুর খুনির দল ৭৫’র ১৫ আগস্টের অসমাপ্ত কিলিং মিশনের দাঁড়ি টানতে ১৯৮৯ সালের ১০ আগস্ট দিবাগত মধ্যরাতে ধানমন্ডি ৩২ নম্বর সড়কের বঙ্গবন্ধু ভবনে গ্রেনেড বোমা হামলার পাশাপাশি বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ করে। এ সশস্ত্র হামলার নেতৃত্বে ছিলেন ফ্রিডম পার্টির সদস্য কাজল ও কবিরের নেতৃত্বে ১০ থেকে ১২ জন অস্ত্রবাজ । আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা তখন দু’তলার কক্ষে অবস্থান করায় প্রাণে রক্ষা পান।

এ ঘটনায় ধানমন্ডি থানায় একটি মামলা হয়। ধানমন্ডি থানায় মামলা নম্বর-২৪, তারিখ- ১১/০৮/৮৯। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) মামলার অভিযোগপত্র দেয়। এতে লেফটেন্যান্ট কর্ণেল (অবসরপ্রাপ্ত) সৈয়দ ফারুক, লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অবসরপ্রাপ্ত) আবদুর রশিদ ও মেজর (অবসরপ্রাপ্ত) বজলুল হুদা এবং নাজমুল মাকসুদ মুরাদসহ ১৬ জনকে আসামি করা হয়।

অভিযোগপত্রে মিজানের ছোট ভাই মোস্তাফিজুর রহমান মোস্তফা হামলার পরিকল্পনাকারী ও হামলাকারী দলের একজন সদস্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পরবর্তীতে নিজেদের মধ্যকার আভ্যন্তরীণ কোন্দলে ফ্রিডম মোস্তফা মারা যান।

সূত্র মতে, মোহাম্মদপুরের শাহজাহান রোডের আব্দুল মালেক মিয়ার ছেলে ফ্রিডম মোস্তফা হত্যা মামলায় আদালতে স্বীক্ষী দিতে গিয়ে হাবিবুর রহমান মিজান স্বীকার করেন তাঁর ছোট ভাইয়ের কান্ডকীর্তি সম্পর্কে তিনি সার্বক্ষণিক খোঁজ খবর রাখতেন। তিনি কী করতেন, কোথায় যেতেন সবকিছুই ছিল তাঁর নখদর্পণে।

ফলে ১৯৮৯-এর ১০ আগস্ট কালো রাতে বঙ্গবন্ধু কন্যা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার পরিকল্পনার বিষয়টিও যে তাঁর অজানা ছিল না প্রকারান্তরে এ বিষয়টিই কী তাহলে আদালতে স্বীকার করেছিলেন ফ্রিডম পার্টির এক সময়কার এ সক্রিয় নেতা? এমন কৌতূহলও তৈরি হয়েছে জনমনে।

একাধিক সূত্র কালের আলোকে অভিযোগ করে বলছে, ‘বঙ্গবন্ধুর মতোই তাঁর জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার মাধ্যমে জাতিকে নেতৃত্বশুন্য করতে চেয়েছিলেন ফ্রিডম মোস্তফারা। কিন্তু তাদের সেই অসৎ উদ্দেশ্য বাস্তবায়িত হয়নি। দেশের আপামর জনসাধারণের ভালোবাসায় সেদিন বেঁচে গেছেন মুজিব কন্যা।’

একই সূত্র বলছে, ফ্রিডম পার্টির পরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের হাঁড়ির খবর ঠিকই মিজানুর রহমান ওরফে হাবিবুর রহমান মিজান জানতেন। নিজের সহোদর ছোট ভাইয়ের অনৈতিক প্রতিটি কর্মকান্ডে তিনি শেল্টার দিয়েছেন। স্বাধীনতা বিরোধী চক্রের এ মূলহোতাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে থলের বিড়াল বেরিয়ে আসবে।’

স্থানীয় মোহাম্মদপুর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা আরো বলছেন, ‘ফ্রিডম পার্টির নেতা হাবিবুর রহমান মিজানরা রঙ বদল করলেও সময়ের অপেক্ষায় ছিলেন। আওয়ামী লীগের নেতা সেজেই তাঁরা মূলত আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে চেয়েছেন। সঠিক তদন্ত হলেই বঙ্গবন্ধু কন্যাকে হত্যাচেষ্টার সেই ঘটনার সঙ্গে তাঁর সম্পৃক্ততার তথ্য উদঘাটিত হবে।’

দলটির মাঠ পর্যায়ের এক নেতার অভিযোগ, আওয়ামী লীগের দুর্দিনে ফ্রিডম পার্টিতে নেতৃত্ব দিয়ে সুদিনে আওয়ামী লীগার বনে যাওয়া হাবিবুর রহমান মিজান ওরফে পাগলা মিজানদের মতো চতুর নেতাদের খোঁজে বের করতে হবে। চলমান শুদ্ধি অভিযানে ওদের পাশাপাশি তাদের গডফাদারদেরও সনাক্ত করতে হবে। কারণ তাদের মুখে মধু অন্তরে বিষ।’

শুক্রবার (১১ অক্টোবর) বিকেলে পাগলা মিজানের মোহাম্মদপুরের আওরঙ্গজেব রোডের বাসায় অভিযান শেষে র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সারওয়ার আলম স্থানীয় গণমাধ্যকর্মীদের বলেন, ‘১৯৮৯ সালে ৩২ নম্বরের বাড়িতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যা করার জন্য যে হামলা করা হয়েছিল, সেই ঘটনার সঙ্গে মিজান ও তাঁর ভাই সংশ্লিষ্ট। তাঁর ভাই এবং তিনি এক সময় ফ্রিডম পার্টির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। এগুলা তদন্তে গুরুত্বসহকারে দেখা হবে।’

কালের আলো/এমএইচ/এমএএএমকে

Print Friendly, PDF & Email