মশক নিধনে সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতার কথা জানালো ডিএসসিসি

প্রকাশিতঃ 9:23 am | September 19, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিঙ্গাপুর থেকে বেশ কয়েকটি অভিজ্ঞতা অর্জন করেছে বলে জানিয়েছেন সংস্থাটির কর্মকর্তারা।

তাঁরা বলছেন, ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে জনসচেতনা সৃষ্টি করতে হবে, টাস্কফোর্সের কার্যক্রম চালাতে হবে, নিয়মিত মশকনিধন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে, ব্যক্তিগত দায়িত্ববোধ বাড়াতে হবে এবং আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে।

সম্প্রতি ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিঙ্গাপুরে অভিজ্ঞতা অর্জনে যান ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ও তার সফর সঙ্গীরা।

সে দেশের অভিজ্ঞতা অর্জন করে দেশে বুধবার (১৮ সেপ্টেম্বর) দুপুরে নগর ভবনের ব্যাংক ফ্লোরে প্রেস ব্রিফিং এর মাধ্যমে এসব বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন ডিএসসিসি’র প্রধান স্বাস্থ্যকর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল শরিফ আহমেদ।

এ সময় পাশে ছিলেন মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন ও প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান।

সিঙ্গাপুরের ডেঙ্গু চিত্র তুলে ধরে বলা হয়, সিঙ্গাপুরে ১৯০১ সালে প্রথম ডেঙ্গু দেখা দেয় এবং ৬০ ও ৭০ এর দশকে ব্যাপক আকার ধারণ করে। গত বছরগুলোতে অর্থাৎ ২০০৫, ২০০৭, ২০১৩, ও ২০১৯ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা যায়। এ বছর সিঙ্গাপুরে ১১ হাজার ডেঙ্গু রোগী সনাক্ত হয় এবং তাদের মধ্যে ১৫ জন মারা যান। সিঙ্গাপুরে ডিইএন-২ সেরোটাইপ বেশি ছিল।

অন্যদিকে বাংলাদেশে ২০০০ সালে প্রথম ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দেয় বলে উল্লেখ করে বলেন, ২০০০-২০১৮ সাল পর্যন্ত ডেঙ্গুর প্রকোপ কম বেশি লক্ষ্য করা যায়। তবে এ বছর ঢাকাসহ পুরো দেশে ডেঙ্গুর ব্যাপক প্রকোপ দেখা দেয়।

ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সিঙ্গাপুরের চ্যালেঞ্জগুলোর মধ্যে ছিলো- দেশের বাইরে থেকে আসা বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি, প্রচুর বিদেশির গমনাগমন, শহরের মানুষের ঘণত্ব বেশি, বেশি তাপমাত্রা এবং কার্যকর মশা নিয়ন্ত্রণ। দেশটিতে এবার ডেঙ্গু রোগী বৃদ্ধির কারণ হিসেবে উল্লেখ করেছে- বেশি মশার জন্ম, বেশি তাপমাত্রা, বাসা বাড়িতে বেশি লার্ভা, মানুষের কম প্রতিরোধ ক্ষমতা।

এডিসের লার্ভার উৎপত্তিস্থল সিঙ্গাপুর আর বাংলাদেশের মধ্যে খুব বেশি পার্থক্য নেই। সেখানে তারা উল্লেখ করেছে ফুলের টব, কৃত্রিম কন্টেইনার (বাংলাদেশে যেটা বলা হয়, বালতি, টায়ার, ডাবের খোঁসা), ছাঁদ বাগান, নির্মাণাধীন ভবন, রূপ গাটার এবং বাঁশের হোল। এর অধিকাংশই বাংলাদেশেও রয়েছে।

ডেঙ্গু প্রতিরোধে সিঙ্গাপুর যেসকল বিষয়ে ওপর জোর দেয়-জনসচেতনতা বৃদ্ধি, নিয়মিত এনটোমলিক্যান ও ইপিওডেমিওলজিক্যাল সাভিলেন্স, ট্যাস্ক ফোর্সের কার্যক্রম, কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করা, নিয়মিত মশক নিয়ন্ত্রণ। এছাড়া এনভায়রনমেন্টাল কন্ট্রোল, কেমিক্যাল কন্ট্রোল ও বায়োলজিক্যাল কন্ট্রোলের কথা বলা হয়েছে। সাথে উল্লেখ করা হয়েছে সবাইকে ব্যক্তিগত দায়িত্ব গ্রহণ এবং আইনগত ব্যবস্থা।

ডেঙ্গু সার্ভিলেন্সের মধ্যে তারা মশা, ভাইরাস, মানুষ, রোগী, ক্লাস্টার এবং আউট ব্রেক পর্যালোচনা করে। সারা বছর ধরে সার্ভিলেন্স করে, ঝুঁকি নির্ণয় করে, ইন্টার সেক্টরাল সমন্বয় করে এবং ডাটা বিশ্লেষণে প্রযুক্তির ব্যবহার করে। মাঠ পর্যায়ে তথ্য সংগ্রহ করে জিআইএস ম্যাপিং এর মাধ্যমে। সেখানে দেখা গেছে যদি ১৫০ মিটার জায়গায় দুই সপ্তাহের মধ্যে ২-৯ জন ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেছে তাহলে সেখানে হলুদ বিপদসংকেত দেখানো হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে সবার কাছে ছড়িয়ে যায়। এর সঙ্গে সকল সংস্থা একযোগে ওই এলাকায় কাজ করে। আর যদি ১৫০ কিলোমিটারের মধ্যে দুই সপ্তাহে ১০ বা বেশি রোগী পাওয়া যায় তাহলে সেটাকে লাল বিপদসংকেত দেওয়া হয়।

সিঙ্গাপুরে প্লাস্টিকের কৌটা আকৃতির এক ধরণের ট্রাপ বসিয়ে দেয় বাসাবাড়িতে। কীটতত্ত্ব সার্ভিলেন্সের ওই ট্রাপে ১১০ হাজার বসতবাড়ির প্রায় ৫০ হাজার গ্রাভিট্রাপ রাখা হয়। এই ট্রাপগুলি ২০-৩০ মিটার দূরে রাখে। যদি ওই ট্রাপগুলোর মধ্যে ১০টিতে দুটি মশার উপস্থিতি পায় তখন তারা এটাকে আউট ব্রেক বলে। তখন আউট ব্রেক ম্যানেজমেন্ট বিভাগ বাড়ি বাড়ি লার্ভার সোর্স ধ্বংস করে। মানুষকে সর্তক করে এবং স্বেচ্ছাসেবীদের কাজে লাগায়। আর এনভায়রনমেন্ট কন্ট্রোলের মধ্যে বাড়িঘর, ড্রেন, জলায়শ পরিষ্কার রাখা।

কেমিক্যাল কন্ট্রোলের ক্ষেত্রে তারা লার্ভিসাইড হিসেবে সপ্তাহে একদিন অ্যাডাল্টি সাইড হিসেবে ডেল্টামেথ্রিন ব্যবহার করে আর আর দুই সপ্তাহে একদিন পাইরিমিফস ব্যবহার করে।

আইনগত, দিক থেকে তারা বেশ কঠোর। সেখানে বসতবাড়িতে যদি লার্ভা পাওয়া যায় তবে ২০০ ডলার এবং নির্মানাধীন ভবনে প্রথম পরিদর্শনে ২ হাজার ডলার, দ্বিতীয় পরিদর্শনে ৪ হাজার ডলার, তৃতীয় পরিদর্শনে ৫ হাজার ডলার এবং পরিবর্তিতে কোর্টে চালান করে দেয়। এমনকি ভবন নির্মাণের অনুমতি বাতিল করে দেয়। যেখানে বাংলাদেশে অভিযান করলেও খুব বেশি জরিমানার আওতায় আসে না।

সিঙ্গাপুর সফরকালে মেয়রের নেতৃত্বাধীন কমিটি গত ১০-১১ সেপ্টেম্বর সেখানে ৪টি সেশনে যোগদান করেন। ওই সফরে মেয়র সাঈদ খোকন ছাড়াও ছিলেন, ডিএসসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান, প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল ডা. মো. শরীফ আহমেদ, কেবিনেট ডিভিশনের উপসচিব মো. শহিদুল ইসলাম, স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-সচিব আ ন ম ফয়জুল হক এবং ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আঞ্চলিক নির্বাহী কর্মকর্তা সালেহা বিনতে সিরাজ।

সফরে তারা ১০ সেপ্টেম্বর সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট এজেন্সিতে এবং এর ডেপুটি চীফ মিনিস্টার খু সিউ পো এবং তার দল “ভেক্টর কন্ট্রোল রেগুলেশন” এর উপর ব্রিফ করেন। ওই দিন বিকেলে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ে বৈঠক হয়। এছাড়া ১২ সেপ্টেম্বর এনভায়রনমেন্টাল হেলথ ইনস্টিটিউটের সঙ্গে বৈঠক করেন।

সফর শেষে দেশটির এনভায়রনমেন্টাল হেলথ ইনস্টিটিউট, সিঙ্গাপুরে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে সর্বশেষ তথ্য বিনিময়, প্রযুক্তির ব্যবহার, কারিগরি সহায়তা ও প্রশিক্ষণ ইত্যাদি বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষরের বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে। সিঙ্গাপুরের অভিজ্ঞতার আলোকে দীর্ঘ মেয়াদী ও টেকসই পরিকল্পনার জন্য ৫ বছর মেয়াদী এক প্রকল্পের ডিপিপি প্রণয়ন শুরু করেছে বলে জানান মেয়র সাঈদ খোকন।

কালের আলো/বিএএ/এমআর

Print Friendly, PDF & Email