সালমানের মৃত্যুর খবরে বাকরুদ্ধ হয়ে ছিলাম : শিল্পী

প্রকাশিতঃ 10:22 am | September 15, 2019

শোবিজ ডেস্ক, কালের আলো:

বাংলা সিনেমার ‘স্টাইল আইকন’খ্যাত একসময়কার তুমুল জনপ্রিয় নায়ক সালমান শাহ। তিনি নেই ২৩ বছর। এই সময়ে পাল্টেছে বাংলা সিনেমার ধরণ, পাল্টেছে অনেক কিছুই।

সেই সময়ের আরেক জনপ্রিয় নায়িকা শিল্পী। যিনি সালমানের সাথে মাত্র একটি মাত্র সিনেমায় কাজ করেছেন। ‘প্রিয়জন’ নামের সেই ছবিটি শিল্পীর ক্যারিয়ারে অনন্য এক পালক যোগ করেছে। সালমানের সঙ্গে শিল্পীর সম্পর্কটা ছিল বেশ মধুর। সেই সম্পর্কের সমুদ্রে বহুদিন পর স্মৃতির জাহাজ ভাসালেন নায়িকা।

সেই সিনেমার অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেন, অভিজ্ঞতা তখনো ভালো, এখনো ভালো। আমি বলবো অভিজ্ঞতা চলমান। এটা সৌভাগ্য যে সালমানের সঙ্গে একটি ছবি করতে পেরেছি আমি। সাধারণত আমরা যারা নব্বই দশকে কাজ করেছি তাদের নিয়ে দর্শকের অন্যরকম একটা ভালো লাগা বা আবেদন কাজ করে। প্রায়ই ছেলেমেয়ের স্কুলে, রাস্তায়, শপিংমলে ভক্তদের কাছ থেকে উপভোগ্য মুহূর্ত পাই। নিজেকে আড়াল করে চলি। তবুও অনেকে বুঝে ফেলেন। দৌড়ে আসেন। বলেন যে আপনি ‘বাবা কেন চাকর’ ছবির নায়িকা না? বা অমুক নায়িকা না? কেউ কেউ বলেন- আপনি তো আমাদের সময়ের নায়িকা। অনেক নারীও অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকেন, ছবি তোলেন।

শিল্পী বলেন, তবে বলতে দ্বিধা নেই, আমি সবচেয়ে বেশি শুনেছি এই কথাটি যে- আপনি সালমান শাহের নায়িকা না? ‘এ জীবনে যারে চেয়েছি’ গানের কথা বলে। এটা সত্যি দারুণ ব্যাপার যে মাত্র একটি ছবি করেছি যে নায়কের সঙ্গে তার নায়িকা হিসেবেই মানুষ আমাকে বেশি চেনে বা জানে। অনেকে সালমানের নায়িকা জানার পর সালমানের ভক্ত হিসেবে অনেক পাগলামির কথা বলেন।

‘একবার ডাক্তার দেখাতে গেলাম এক চেম্বারে, তিনিও সালমানের নায়িকা হিসেবে আমাকে নোটিশ করলেন। আসলে সালমান নব্বই দশকের টিনেজারদের প্রিয় নায়ক ছিল। আইকন ছিল ও। আজকে অনেক এসপি-ডিসি-ডাক্তার বা বিভিন্ন উচ্চপর্যায়ে প্রতিষ্ঠিতরা সালমানভক্ত ছিলেন। সালমান সবশ্রেণির মানুষের কাছে নিজেকে জনপ্রিয় করে তুলতে পেরেছিল। এটাই ওর সবচেয়ে বড় ম্যাজিক বা সাফল্য।’

তিনি আরও বলেন, এই যে আজ আপনি আমার সঙ্গে এত আগে থেকে যোগাযোগ করে শিডিউল মিলিয়ে দেখা করতে এলেন এটাও তো সালমানের সঙ্গে ওই সিনেমাটি করার অভিজ্ঞতাই দিচ্ছে। সিনেমা ছেড়ে দিয়েছি ১৯ বছর হয়। আমার সাক্ষাৎকারের কোনো দরকার পড়ে না। তবুও আপনি এলেন সালমানের নায়িকা এই মূল্যায়ন করে। সালমান সম্পর্কে দুটো কথা শুনবার ও জানবার আগ্রহ থেকে।

সালমান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, অনেক মজা করতো সালমান সেটে। মেকাপ রুমে এসে পর্যন্ত জ্বালাতো। হয়তো আমি চোখে কাজল দিচ্ছি ও পেছন থেকে এসে বলতো, ‘ইশ, কেন যে কাজল হলাম না।’ হয়তো ঠোঁটে লিপস্টিক দিচ্ছি। ও দেখতে পেরেছে বা জানতে পেরেছে। পেছনে দাঁড়িয়ে সিনেমার সংলাপ দেয়ার স্টাইলে বলতো, ‘হায়রে, নায়িকার লিপস্টিক হতে পারলাম না!’ তার মুখে এসব শুনে শুনে আমি লজ্জায় লাল হতাম।

নব্বই দশকের জনপ্রিয় এই নায়িকা বলেন, কিন্তু সালমান ‘ভালগার’ ছিল আমার মনে হয় এই কথাটা কেউ বলতে পারবে না। ও দুষ্টামি-মজাগুলো করতো সবাইকে মাতিয়ে রাখার জন্য। শুটিং করছি হঠাৎ বলে বসলো চলো সবাই পুরান ঢাকায় যাই। খাবো। প্রযোজক তো শুনে অজ্ঞান হয় হয়। শুটিং রেখে নায়ক-নায়িকারা চলে যাওয়া মানে বিপদ। ফেরে কি না ফেরে কোনো ঠিক আছে নাকি! তো প্রযোজক এসে সালমানকে থামাতে বলছে, ‘কষ্ট করে যাওয়ার দরকার নেই। কী খাবেন আমি আনিয়ে দিচ্ছি।’ সালমান হতাশ হয়ে তাকিয়ে থাকতো। আমি হাসতাম আড়ালে বসে। এগুলো সে ইচ্ছে করে করতো।

তিনি বলেন, মনে পড়ে ‘প্রিয়জন’ ছবির শুটিং করতে কক্সবাজার গিয়েছি। সেখানে অনেক মজা করেছি। সালমান তার স্ত্রীকে প্রায়সময়ই আউটডোরে শুটিং হলে নিয়ে যেতো। সেবারও কক্সবাজারে নিয়ে গিয়েছিল। ওরা উঠেছিল প্রবাল হোটেলে। আমি, রিয়াজসহ অন্যরা ছিলাম শৈবালে। প্রচুর আড্ডা মেরেছি আমরা।

প্রিয়জন সিনেমার নায়িকা বলেন, প্রতিদিনই সকালে কল টাইম থাকতো। আউটডোরে গেলে একটু সকাল সকাল কাজ করতে হয়। তো একদিন কোনো শুটিং নেই। ভাবলাম আরাম করে ঘুমাবো। সালমান সেদিন ভোর ৬টার দিকে এসে চিৎকার চেচামেচি করে সবাইকে জাগিয়ে তুলে দিয়ে চলে গেল। এই হলো সালমান।

‘কক্সবাজারে আমরা অনেক মজা করেছি। রিয়াজ তখন ভালো ড্রাইভ জানতো না। আইল্যান্ডের উপর চড়িয়ে দিতো। সে নিয়ে সালমান ওকে ক্ষেপাতো। রিয়াজের সঙ্গে ও খুব মিশেছিল। দেশের বাইরেও আমাদের অনেক মজার অভিজ্ঞতা আছে। হঠাৎ হঠাৎ মনে পড়ে। কখনো ভালো লাগে। কখনো মন খারাপ হয়।’

প্রিয়জন ছবিটি ১৯৯৬ সালের জুন মাসে মুক্তি পেয়েছিল। এর দুই মাস পরই সালমান মারা যান। তার সঙ্গে কি ছবিটি দেখা হয়েছিল? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, না। সেই সুযোগ হয়নি। তখন সালমানও অনেক ব্যস্ত, আমিও শুটিং নিয়ে ব্যস্ত। তবে আলাদা আলাদা করে দুজনেই হলে গিয়ে ছবিটি দেখেছিলাম নিজেদের শিডিউল বের করে।

সালমানের সাথে সম্পর্ক নিয়ে বলেন, আমরা সমবয়সী ছিলাম। কিন্তু সিনেমায় সালমান আমার চেয়ে দুই বছরের সিনিয়র। এই ভাবটা কোনোদিন ওর মধ্যে ছিল না। ও সবসময় আগে রেসপন্স করতো। নিজের চোখে অনেক কিছু দেখেছি এই ইন্ডাস্ট্রিতে। অনেক নায়কের অনেক রকম দাপট ছিল। আজ কিছুই নেই। এমন নায়কও ছিল দশজন বডিগার্ড সঙ্গে নিয়ে এফডিসিতে বা শুটিং স্পটে আসতো।

‘তবে সালমান ছিল অন্য রকম একটা ছেলে। একেবারেই অন্যরকম। ওকে দেখলেই মনে হতো চিন্তা চেতনায় ও স্টাইল রুচিতে একটু এগিয়ে। ওর স্ত্রীর অবশ্য একটা ভূমিকা ছিল। এটা হয়তো অনেকে জানে না। আমরা যারা কাজ করেছি তারা দেখেছি। সালমানের পোশাক, মেকাপ ঠিক করে দিতো সামিরা। আরেকটা কথা বলি। শাবনূর যখন প্রথমদিকে আসলো তখন দেখবেন অতটা গ্ল্যামারাস ছিল না। সাদা রঙের ভারী মেকাপ করতো। যখন সালমানের সঙ্গে ছবি করতে শুরু করলো শাবনূরের বাহ্যিক পরিবর্তনটা চোখে লাগলো সবার। ওর মেকাপ, চুলের স্টাইল একেক ছবিতে একেক রকম করে দিতো সামিরাই। গানে সালমান-শাবনূরের ম্যাচ করে পোশাক পরা এগুলো সামিরার ডিজাইন ছিল।’

তিনি বলেন, সালমানের মৃত্যুর পর আমরা রিয়াজ-শাকিলকে সেসব ফ্যাশন-স্টাইলে দেখেছি। কিন্তু সালমানের মতো ছিল না। এ সময়ে শাকিব অনেক স্টাইলিশ। অনেক ব্রান্ডের পোশাক পরে, ভালো গেটাপ দেখা যায়। কিন্তু সালমানেরটা একেবারেই ভিন্ন। সালমান যদি মারা না যেত অনেক নায়কেরই ক্যারিয়ার দাঁড়াতো না। এটা কিন্তু সত্যি। আর সালমানের যে দূরদর্শী ভাবনাশক্তি ছিল এতদিনে ও বলিউডের সঙ্গে বেশ ভালোভাবেই মিশে যেত বলে মনে হয় আমার।

তিনি আরও বলেন, এটা অন্য প্রসঙ্গ। এখন থাক। সালমান আমাকে ম্যাডাম বলে ডাকতো। আমি তো তখন সবে ঢুকেছি ইন্ডাস্ট্রিতে। সেটা ১৯৯৫ সালের শেষ দিকে। মোহাম্মদ হোসেনের পরিচালনায় আমিন খানের সঙ্গে ‘বাংলার কমান্ডো’ ছবিটি মুক্তি পেয়েছে মাত্র। নাম ছড়াচ্ছে। সবাই আমার গ্ল্যামারের প্রশংসা করছে। একের পর এক ছবি আসছে। কত নায়ক ছিল দেখেও না দেখার ভান করতো। কিন্তু সালমান এমন ছিল না।

‘সালমানের সঙ্গে আমার দেখা হতো এফডিসিতে ঢোকার সময়। আমি ঢুকতাম তো সালমান গাড়ি নিয়ে বের হচ্ছে। নয়তো সে ঢুকছে আমি বের হচ্ছি। প্রত্যেকবার সালমান গাড়ি থামিয়ে ডাকতো, ‘ম্যাডাম কেমন আছেন? কবে একটা ছবি করবেন আমার সাথে বলুন’! আমি মজা পেতাম, লজ্জাও পেতাম। তখন সালমান সুপারহিট। ওর মতো নায়ক এভাবে কেন বলতো? একটা নতুন মেয়েকে সাপোর্ট দেয়ার জন্য, সাহস দেয়ার জন্য।’

সালমানের মৃত্যুর দিনের কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, সেদিন তো শুক্রবার ছিল। সকালে ঘুম থেকে উঠেছি কেবল। বারান্দায় গেলাম। হঠাৎ শুনলাম সালমান শাহ মারা গেছে। আমি ভাবলাম মজা করছে কী না। পরে দেখলাম যে না লোকগুলো বেশ সিরিয়াস। সাথে সাথে খোঁজ নিলাম। জানলাম, সত্যি সালমান আর নেই! বাকরুদ্ধ হয়ে ছিলাম। ওর সঙ্গে আরও অনেক কাজের কথা ছিল।

কালের আলো/এনআর/এসএফ

Print Friendly, PDF & Email