১৪ বছরেও শেষ হয়নি সিরিজ বোমা হামলার বিচার

প্রকাশিতঃ 11:40 am | August 17, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট দেশের ৬৩ জেলায় ৫৫০টি স্থানে একযোগে সিরিজ বোমা হামলা চালিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছিল জঙ্গি সংগঠন জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি)।

এতে দু’জন নিহত ও ১০৪ জন আহত হন। আজ এই হামলার ১৪ বছর। হামলার পর ১৫৯টি মামলার মধ্যে ৫৯ মামলার বিচার এখনও শেষ হয়নি। অন্য মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয়েছে। সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাই মাসে ফরিদপুরের একটি মামলায় ৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

সিরিজ বোমা হামলার ঘটনার পর জড়িত এক হাজারেরও বেশি জঙ্গি ধরা পড়ে। তবে অনেকেই জামিন নিয়ে এখনও পলাতক। পুলিশ সদর দফতর ও র‌্যাব সদর দফতর সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জঙ্গি দমনের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা জানান, সিরিজ বোমা হামলায় জড়িত জেএমবি এখন দুটি ধারায় বিভক্ত। পুরনো জেএমবি ও নব্য জেএমবি এই দুটি ধারায় বিভক্ত হয়ে এখনও তারা তৎপর হওয়ার চেষ্টা করছে। বিশেষ করে পুরনো জেএমবির শীর্ষ নেতা সালাউদ্দিন সালেহীন এখন ভারত থেকে সংগঠনটির নেতৃত্ব দিচ্ছে।

অপরদিকে গুলশান ও শোলাকিয়ার ঈদগাহে হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মুখে নব্য জেএমবি সাংগঠনিকভাবে দুর্বল হয়ে গেছে। শীর্ষ জঙ্গিদের অনেকেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছে। অনেকে আবার ধরা পড়েছে। কারাগারের বাইরে থাকা জঙ্গিরা গোপনে তৎপর হওয়ার চেষ্টা করছে। সূত্র জানায়, হামলার ঘটনায় দায়ের করা ১৫৯ মামলায় আসামি করা হয় ১৩০ জনকে। তবে অভিযোগপত্রে এক হাজার ৭২ জনকে আসামি করা হয়। তাদের মধ্যে জামিনে আছে ১৩৩ আসামি।

বিভিন্ন অভিযানে গ্রেফতার করা হয় ৯৬১ জনকে। সাজাপ্রাপ্ত ৩২২ জনের মধ্যে ২৭ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। এর মধ্যে ৬ জনের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে। বাকি ২১ জন এখনও পলাতক। এসব মামলায় খালাস দেয়া হয়েছে ৩৫৩ জনকে। বাকি আসামিরা পলাতক। ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয় ১৭টি মামলার। অভিযোগপত্র দেয়া হয় ১৪২টি মামলার। মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় সর্বোচ্চ ২৩টি মামলা হয় ঢাকা ও খুলনা রেঞ্জে।

সর্বনিম্ন ৩টি করে মামলা হয় খুলনা মহানগর ও রেলওয়ে রেঞ্জে। মহানগরীগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয় ডিএমপিতে। ডিএমপিতে ১৮টি মামলা হলেও ৯টি মামলায় চার্জশিট দেয়া হয়েছে।

ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া হয়েছে ৯টি মামলায়। এ পর্যন্ত হামলায় জড়িত সাত আসামির স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। আর মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা ছয় আসামি হল- শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ ও ইফতেখার হাসান আল মামুন।

সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় করা অনেক মামলা এখনও নিষ্পত্তি হয়নি। এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌঁসুলি মো. আবদুল্লাহ আবু বলেন, সিরিজ বোমা হামলার ঘটনায় ঢাকায় ১৬টি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে কয়েকটি মামলায় ফাইনাল রিপোর্ট ও কয়েকটি মামলায় চার্জশিট দেয়া হয়েছে।

চার্জশিট দেয়া মামলাগুলোর মধ্যে দুটি মামলায় রায়ও হয়েছে। বাকি কয়েকটি মামলা সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে। কিছু মামলায় সাক্ষীরা আদালতে সাক্ষ্য দিচ্ছেন না। আর সাক্ষী না আসায় এর সুবিধা ভোগ করছেন আসামিরা। এভাবে যদি সাক্ষীদের খুঁজে পাওয়া না যায় তাহলে শিগগিরই মামলাগুলোয় সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায় শেষ করে চূড়ান্ত নিষ্পত্তির দিকে যাব।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, জঙ্গিরা বেশির ভাগ স্থানেই রিমোট কন্ট্রোলের মাধ্যমে বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। কোথাও কোথাও টিফিন ক্যারিয়ারে বোমা রাখা ছিল। হামলার স্থান হিসেবে ওরা সুপ্রিমকোর্র্ট, জেলা আদালত, বিমানবন্দর, বাংলাদেশের মার্কিন দূতাবাস, জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কার্যালয়, প্রেস ক্লাব ও সরকারি-আধাসরকারি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা বেছে নেয়।

পুলিশ সদর দফতরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি-মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, সিরিজ বোমা হামলার সব মামলার তদন্ত শেষ করে যথাসময়ে আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেছিল পুলিশ। অধিকাংশ মামলাই ইতিমধ্যে আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে। অবশিষ্ট কিছু মামলা এখনও বিচারাধীন। জামিনে মুক্ত বা সাজা ভোগ শেষে মুক্ত জঙ্গিদের ওপর নজর রাখছে পুলিশ।

দেশের প্রতিটি বিভাগের জন্য আলাদাভাবে ডাটাবেজ তৈরির কাজ শেষের দিকে। ডাটাবেজে জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িত এবং মামলার আসামি জঙ্গিদের সার্বিক তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে। এর ফলে জঙ্গি বা জঙ্গি কার্যক্রমে জড়িতদের ওপর নজরদারি আরও সহজ হবে।

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল এমরানুল হাসান বলেন, জঙ্গি দমনকে অগ্রাধিকার দিয়েই র‌্যাবের কার্যক্রম চলে। ২০১৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বোমা হামলার অধিকাংশ আসামি র‌্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে। জঙ্গি দমনে গোয়েন্দা তৎপরতা চলমান রয়েছে। এখন জঙ্গিরা অনলাইনেও তৎপর রয়েছে। র‌্যাব সাইবার মনিটরিং সেলের মাধ্যমে সেখানেও নজরদারি করছে। এর মাধ্যমে অনেকগুলো অভিযানও চালানো হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, ২০০৫ সালে দেশজুড়ে সিরিজ বোমা হামলাকে তারা ‘সাউন্ড ব্লাস্ট’ নামে আখ্যায়িত করেছে। যেসব স্থানে সিরিজ বোমা হামলা হয়েছে প্রতিটি জায়গায় তারা ‘ইসলামী আইন বাস্তবায়ন’ শিরোনামে লিফলেট ফেলে যায়। এছাড়া জেএমবি প্রতিষ্ঠার পর থেকে একের পর রক্তক্ষয়ী হামলা চালায়।

২০০১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরার গুড়পুকুরের রক্সি সিনেমা হল ও সার্কাস মাঠে বোমা হামলা চালায় তারা। এরপর থেকে ২০১৩ সাল পর্যন্ত অন্তত অর্ধশত হামলায় জড়িত ছিল জেএমবি।

এসব হামলায় শতাধিক ব্যক্তি নিহত হন। জেএমবির হামলার মধ্যে রয়েছে ময়মনসিংহে সিনেমা হলে বোমা হামলা, নাটোরে বোমা হামলা। রাজধানীর গোপীবাগে সিক্স মার্ডার ও ফার্মগেটে মাওলানা ফারুকী হত্যায়ও জেএমবি জড়িত।

এখন দেশে পুরনো জেএমবির চার শতাধিক নেতাকর্মী গোপন কার্যক্রম চালাচ্ছে। কারাগারে আছে পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। শীর্ষ নেতা সালাউদ্দিন সালেহীনসহ কয়েকজন ভারতে পলাতক রয়েছে। এখন বড় ধরনের হামলার সক্ষমতা তাদের নেই। তবে গোপন তৎপরতা থেমে নেই।

জঙ্গি দমনের সঙ্গে যুক্ত দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা জানান, ২০১৬ সালে গুলশান ও শোলাকিয়ায় ভয়াবহ জঙ্গি হামলা চালিয়ে আতঙ্ক ছড়ায় জেএমবির নব্য ধারা (নব্য জেএমবি)। এই দুটি হামলার পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতার মুখে সংগঠনটির শীর্ষ নেতা তামিম চৌধুরীসহ অন্তত ৭০ জঙ্গি নিহত হয়। অনেক শীর্ষ নেতা গ্রেফতার হয়ে এখন কারাগারে। সংগঠনটি দুর্বল হয়ে পড়লেও নিঃশেষ হয়ে যায়নি। কারাগারের বাইরে থাকা জঙ্গিরা এখনও গোপনে তৎপর হওয়ার চেষ্টা করছে।

কালের আলো/এনআর/এমএইচএ

Print Friendly, PDF & Email