আতঙ্কে কারাগারের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা, ৪৯ জনের দুর্নীতির তথ্য দুদকের হাতে

প্রকাশিতঃ 7:11 am | July 30, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :

দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) অভিযানে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের ডিআইজি প্রিজনস পার্থ গোপাল বণিকের ফ্ল্যাট থেকে ঘুষ-দুর্নীতির ৮০ লাখ টাকা উদ্ধারের ঘটনাকে কেন্দ্র করে চরম আতঙ্কে রয়েছেন কারাগারের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা। এসব কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে তদন্তে দুর্নীতির তথ্য পেয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।

কারাগারের পরতে পরতে দুর্নীতির বাসা বাঁধানো ২ জন জ্যেষ্ঠ জেল সুপার, ৭ জন ডেপুটি জেলারসহ মোট ৪৯ জন অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। পার্থ গোপালের পর যে কোনদিন তাদের বিরুদ্ধেও অ্যাকশন শুরু হতে পারে। এর ফলে তাদের আর ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকার সুযোগ মিলছে না বলে কালের আলোকে জানিয়েছে একাধিক সূত্র।

জানা যায়, ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাসকে ময়মনসিংহগামী ট্রেন থেকে নগদ ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার এফডিআর (স্থায়ী আমানত) ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার নগদ চেক, ১২ বোতল ফেনসিডিলসহ গ্রেফতার করে রেলওয়ে পুলিশ।

এরপর রানার অর্থের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির সন্ধান পায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি। পরে তাঁরা কারা অধিদপ্তরে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়।

সূত্র জানায়, ঘুষের টাকাসহ হাতেনাতে ধরা জেলার সোহেল রানা সেই সময় চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছিলেন। তিনি জানিয়েছিলেন পার্থ বণিককে তিনি ঘুষের ভাগ দিয়েছেন। এমন অভিযোগ উঠার পরই ডিআইজি প্রিজনস পার্থ গোপাল বণিককে সিলেটে বদলি করা হয়।

আর সোহেল রানার ঘুষের বিষয়ে তদন্ত করতে গিয়ে যেন ‘কেঁচো খুঁড়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করে সাপ’। ওই সময় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটি ডিআইজি প্রিজনস পার্থ বণিকসহ ৫০ জনের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে। দুদকও এ কমিটির কাছ থেকে তথ্য পায়। এরপর তাঁরা নিজেরাও ওইসব কর্মকর্তা-কর্মচারীর অনিয়ম ও দুর্নীতির বিষয়ে নিবিড়ভাবে তদন্ত কার্যক্রম সচল রাখে।

দীর্ঘ অনুসন্ধানের পর রোববার (২৮ জুলাই) বিকেলে দুদকের পরিচালক মুহাম্মদ ইউসুফের নেতৃত্বে উচ্চপর্যায়ের একটি দল পার্থ গোপাল বণিকের রাজধানীর গ্রিন রোড সংলগ্ন ভূতের গলির বাসায় তল্লাশি চালিয়ে ৮০ লাখ টাকা উদ্ধার করে। পরে ডিআইজি প্রিজনস পার্থ গোপালকে গ্রেফতার দেখানো হয়।

সূত্র মতে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে টানা তৃতীয় মেয়াদে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর দুর্নীতির বিরুদ্ধে ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি অনুসরণ করছে সরকার। সরকারের এ মেয়াদে পুলিশ কনস্টেবল নিয়োগে শতভাগ স্বচ্ছতার ভিত্তিতে মাত্র ১০০ টাকা খরচায় গরিব পরিবারের সন্তানরা চাকরি পেয়েছে। পুলিশ মহাপরিদর্শকের (আইজিপি) এমন সততার প্রশংসা করে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান ইতোমধ্যেই তাকে চিঠি পাঠিয়েছেন।

এদিকে, কারাগারে সীমাহীন অনিয়ম ও দুর্নীতির খবরও ‘ওপেন সিক্রেট।’ আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষের দিকে কারাগারে দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন শুরু করে সরকার। ঘুষের মোটা অংকের টাকাসহ প্রথমে ধরা পড়েন চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার সোহেল রানা।

এর ঠিক ৯ মাসের মাথায় কারাগারের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তা ডিআইজি প্রিজনস দুদকের হাতে ধরা পড়েছেন। ফলে আর শেষ রক্ষা হচ্ছে না চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের সাবেক জ্যেষ্ঠ জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিকেরও। তিনি এখন বরিশালের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ওই কমিটি এই দুই বণিকের অবৈধ সম্পদ অর্জনের বিষয়ে দুদককে তদন্ত করতে সুপারিশ করেছিল।

একই কমিটির অনুসন্ধানে অবৈধ সম্পদ অর্জনের দায়ে অভিযুক্ত বাদ বাকী ৪৭ কর্মকর্তা-কর্মচারী হচ্ছেন- চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের তৎকালীন জ্যেষ্ঠ জেল সুপার ইকবাল কবির চৌধুরী, জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস, ডেপুটি জেলার মুহাম্মদ মুনীর হোসাইন, মো. ফখর উদ্দিন, মো. আতিকুর রহমান, মুহাম্মদ আবদুস সেলিম, হুমায়ন কবির হাওলাদার, মনজুরুল ইসলাম, সৈয়দ জাবেদ হোসেন, সহকারী সার্জন ডা. মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ফার্মাসিস্ট রুহুল আমিন, রামেন্দু মজুমদার পাল, কর্মচারী লায়েস মাজহারুল হক।

কারারক্ষী ও অন্যান্য কর্মচারীর মধ্যে ছিলেন- মো. আবুল খায়ের, নূর আলম, গাজী আবদুল মান্নান, মো. তাজউদ্দিন আহমেদ, আবদুর করিম, মোসলেম উদ্দিন, বেলাল হোসেন, হিসাবরক্ষক এমদাদুল ইসলাম, ক্যানটিন ম্যানেজার উলিউল্লাহ, এইচ এম শুভন, কাউছার মিয়া, আরিফ হোসেন, আনোয়ার হোসেন, মিতু চাকমা, শহিদুল মাওলা, শরিফ হোসেন, জুয়েল রানা, আনোয়ার হোসেন, স্বপন মিয়া, মহসিন দপাদার, আনজু মিয়া, লোকমান হাকিম, শিবারন চাকমা, ত্রিভূষণ দেওয়ান, অংচহ্না মারমা, রুহুল আমিন, শাহাদাত হোসেন, শাকিল মিয়া, আবদুল হামিদ, ইকবাল হোসেন, শামীম শাহ, মো. উসমান, মো. বিল্লাল হোসেন ও অডিট টিমের সদস্য আবু বকর সিদ্দিকী।

সূত্র জানায়, দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) এ অভিযানে চরম আতঙ্কে রয়েছেন কেরানীগঞ্জ, সিলেটসহ দেশের বিভিন্ন কারাগারের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। দুর্নীতিবাজ এসব কর্মকর্তারাও যে কোন সময় দুদকের মাধ্যমে আইনের আওতায় আসবেন বলেও খবর রয়েছে।

কালের আলো/এসটিএম/এএ

Print Friendly, PDF & Email