৮ জনের প্রাণহানির ঘটনার বিশ্লেষণ আইজিপির, ৩১ মামলায় গ্রেফতার ১০৩

প্রকাশিতঃ 4:23 pm | July 24, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :

‘ছেলেধরা’ সন্দেহে গণপিটুনিতে ৮ নিরীহ ও নিরাপরাধ সাধারণ মানুষের প্রাণহানির ঘটনার অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করেছে পুলিশ। তবে এসব কিলিংয়ের সঙ্গে ‘ছেলেধরা’ ঘটনার কোন সম্পৃক্ততা পায়নি পুলিশ সদর দফতর। পুলিশ প্রধান ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, বিপিএম (বার) প্রতিটি ঘটনাই বিশ্লেষণ করেছেন।

আরও পড়ুন: ‘গলাকাটা’ গুজব প্রতিরোধ ও প্রতিকারে কী করছে পুলিশ, জানালেন আইজিপি

৮ জনের প্রাণহানির ঘটনার মধ্যে ৬ জনের প্রাণহানির বিষয়টি তিনি সংবাদকর্মীদের সামনে উপস্থাপন করেন। বাদ বাকী দু’টি ঘটনাও গুজবের ভিত্তিতেই ঘটেছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ মহাপরিদর্শক। একই সঙ্গে এ ধরণের গুজব রটনা ও সহিংস ঘটনার প্রেক্ষিতে সারা দেশে বুধবার (২৪ জুলাই) পর্যন্ত ৩১ টি মামলায় ১০৩ জনকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ।

বুধবার (২৪ জুলাই) বেলা ১১টায় পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে নিজের এমন বিশ্লেষণ মিডিয়ার সামনে তিনি তুলে ধরেন।

আরও পড়ুন: দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির অপপ্রয়াস চালাচ্ছে স্বার্থান্বেষী মহল : আইজিপি

নেত্রকোণায় গলাকাটা রবিন ছিলেন মাদকাসক্ত
পুলিশ প্রধান বলেন, নেত্রকোণায় গত ১৮ জুলাই শিশু সজিব মিয়ার মাথা যার কাছে পাওয়া গিয়েছিল সেই রবিন (২৮) ছিলেন একজন মাদকাক্ত। মাদকাসক্তের জন্য এ রবিন ২০১৭ এবং ২০১৮ তে নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তাঁর অপরাধী কর্মকান্ডের জন্য পুলিশ তাকে কিছুদিন আগেও গ্রেফতার করেছিল।

নিজের স্ত্রীর ওপর আক্রমণ করে ব্লেড দিয়ে গলাকেটে ফেলতে হামলে পড়েছিল। এজন্য স্ত্রী তাকে ছেড়ে চলে যায়। এই রবিনের কারণে তাঁর বাবা তাদের সম্পত্তি বিক্রি করতে বাধ্য হয়েছিল। দু:খজনকভাবে বলতে চাই, যে শিশুটি মারা গেছে মৃত্যুর পূর্বে তাকে বলাৎকার করা হয়েছিল। যার প্রমাণ আমরা সুরতহাল এবং ময়না তদন্তের রিপোর্টে পেয়েছি।

আমরা পারিপার্শ্বিক ঘটনার প্রেক্ষিতে বলতে পারি, বলাৎকারের প্রেক্ষিতে হয়তো ছেলেটি প্রতিহত করতে চেয়েছিল, কিংবা যেহেতু নিজের প্রতিবেশী বা পরিচিত ছিল তাঁর পরিবার, এ কথা বলে দেবে ভেবেই তাকে হত্যা করা হয়েছে।

পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, বিপিএম (বার)। ছবি-আনিসুর রহমান ফারুক

আরও পড়ুন: গুজব রটানোর অভিযোগে ৬০ ফেসবুক ও ১০ অনলাইন বন্ধ : আইজিপি

বাড্ডায় রেণুকে হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার ৭
রাজধানীর বাড্ডায় ছেলেধরা সন্দেহে তাসলিমা বেগম রেণুকে পিটিয়ে হত্যার ঘটনায় পুলিশ ৭ জনকে গ্রেফতার করেছে বলে জানিয়েছেন আইজিপি। তিনি বলেন, ওই নারী তাঁর সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করাতে খোঁজ খবর নিতে এসেছিল।

কিন্তু ছেলেধরা সন্দেহের গুজব রটিয়ে নিরাপরাধ ওই মহিলাকে নির্মমভাবে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে এ ঘটনায় ৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। একজন ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে। আমরা ভিডিও ফুটেজ দেখে প্রত্যেক ব্যক্তিকে সনাক্ত করে ইনশাল্লাহ আইনের আওতায় আনবো।

যাত্রাবাড়িতে বাড়িওয়ালার সঙ্গে ভাড়াটিয়ার বাক বিতন্ডা
যাত্রাবাড়িতে ঘটনাটি নিছক বাড়িওয়ালার সঙ্গে ভাড়াটিয়ার বাক বিতন্ডা বলে জানান পুলিশের আইজি। তিনি বলেন, ‘ভাড়াটিয়া জুন মাসের ভাড়া না দেওয়ায় বাড়িওয়ালা ছেলেধরা বলে চিৎকার করে আশেপাশের লোকজন জড়ো করে তাকে পিটুনি শুরু করে। কিছু না জেনে বা না বুঝে সেখানে অনেকেই জড়িত হন।

বিষয়টি কোনভাবেই ছেলেধরা সম্পৃক্ত ছিল না। স্রেফ নিছক নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য বাড়িওয়ালা এ কাজ করেছেন। তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জড়িতদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় আনার চেষ্টা চলছে।

আরও পড়ুন: কাল থেকে সচেতনতা সপ্তাহ, জুম্মার খুতবায় গুজব বিরোধী বক্তব্য দেবেন ইমামরা

পুলিশ সদর দফতরের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী, বিপিএম (বার)। ছবি-আনিসুর রহমান ফারুক

কেরানীগঞ্জের ঘটনাও ছেলেধরা সম্পৃক্ত নয়
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) জানান, গত ১৯ জুলাই রাতে কেরানীগঞ্জের জনৈক ব্যক্তি সিএনজি ভাড়া করে ঢাকায় আসতে চেয়েছিলেন। সিএনজিওয়ালার সঙ্গে যাত্রীর বাক বিতন্ডা হয়। এক পর্যায়ে যাত্রী ছেলেধরা, গলাকাটা বলে চিৎকার করে। আশেপাশের লোকজন আসায় সিএনজিওয়ালা পালিয়ে যায়। সেখানে দু’জন নিরীহ ব্যক্তির ওপর মানুষজন ঝাঁপিয়ে পড়ে। এ ঘটনায় দু’জনের মধ্যে একজন মৃত্যুবরণ করে। এ ঘটনাটিও কোনক্রমেই ছেলেধরার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।

আরও পড়ুন: গুজবে কান না দিয়ে শিশুদের পদ্মা সেতু ঘুরে দেখার আহ্বান আইজিপির

সাভার ও নারায়ণগঞ্জের ঘটনা
আইজিপি জানান, সাভারে গণপিটুনিতে মানসিক প্রতিবন্ধী এক নারীকে মেরে ফেলা হয়েছে গত ২০ জুলাই। যেহেতু সে মানসিক প্রতিবন্ধী ছিল হয়তো মানুষ জিজ্ঞাসাবাদ করেছে ঠিকমেতা কথার জবাব দিতে পারেনি। আমাদের দেশে অনেক মানসিক প্রতিবন্ধী রাস্তায় ভবঘুরে ঘুরে বেড়ায়। হয়তো সে নিজের পরিচয় বা নাম বলতে পারিনি। যেটা সবাই লক্ষ্য করেছেন। তাকে গণপিটুনিতে মারা হয়েছে।

নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে ঘটনায় নিহত মানসিক এবং বাক প্রতিবন্ধী। সন্তানকে দেখতে যাওয়ার পথে ঘটনাস্থলে স্থানীয় লোকজন তাঁর কাছে চুড়ি এবং লিপিস্টিক দেখে তাকে মারপিট করেছে। যেহেতু তিনি বাক প্রতিবন্ধী ছিল তাই হয়তো কথা বলতে পারেনি। তাকে পিটিয়ে মেরে ফেলা হয়েছে।

আরও পড়ুন: জঙ্গি দমনে ‘বাংলাদেশ মডেল’ ও অপতৎপরতার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের অঙ্গীকার আইজিপির

বাড়বে গ্রেফতারের সংখ্যা
পুলিশ প্রধান ড.মোহাম্মদ জাবেদ পাটোয়ারী প্রতিটি প্রত্যেকটি ঘটনা বিশ্লেষণ করে বলেন, এসব ঘটনায় মৃত বা আহত ব্যক্তি কেউ ছেলেধরা নন। ইতোমধ্যেই এ ধরণের গুজব রটনা ও সহিংস ঘটনার প্রেক্ষিতে সারা দেশে আজ পর্যন্ত ৩১ টি মামলা রুজু করেছি। এবং ১০৩ জনকে গ্রেফতার করেছি। হয়তো এ সংখ্যাটি আরো বাড়বে। হয়তো মর্নিং রিপোর্ট আসার পর গ্রেফতারের সংখ্যা আরো বৃদ্ধি পাবে।

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাবের মহাপরিচালক ও অতিরিক্ত আইজিপি ড.বেনজীর আহমেদ, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের (এসবি) প্রধান মীর শহীদুল ইসলাম, সিআইডি প্রধান শফিকুল ইসলাম, অতিরিক্ত আইজিপি (অর্থ) শাহাবুদ্দিন কোরায়শী, অতিরিক্ত আইজিপি (এইচআরএম) চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল মামুন, পুলিশের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানাসহ পুলিশের উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

আরও পড়ুন: ৮ জনের প্রাণহানির ঘটনার বিশ্লেষণ আইজিপির, ৩১ মামলায় গ্রেফতার ১০৩

কালের আলো/কেএএই/এমএএএমকে

Print Friendly, PDF & Email