বুড়া লইয়াই থাইকো

প্রকাশিতঃ 7:36 pm | July 18, 2019

মনদীপ ঘরাই ::

আমাদের জীবন এখন ট্রেন্ডে গা ভাসানোর এক জীবন। অথচ, বছর দশেক আগেও এই “ট্রেন্ড” নামক শব্দটাই আমাদের অনেকের ডিকশনারিতে ছিল না। এই ট্রেন্ডের বাংলাটা হল “চল”। আগেও আমরা পোশাক, গান, সিনেমা এসবের কোনটার চল আছে সেই বুঝে গা ভাসাতাম; তবে সোশ্যাল মিডিয়া আসার পর তা বেড়ে গেছে কয়েকশো গুণ। তা এতসব বলছি কি কারণে, তাই তো? তাহলে মূল আলাপে আসি। কয়েকদিন ধরে সোশ্যাল মিডিয়ায় কি দেখছেন? উত্তর একটাই: বৃদ্ধ অর্থাৎ বুড়ো মানুষের ছবি। যদিও সত্যি সত্যি বুড়ো না, ওই যে,”ফেসঅ্যাপ ট্রেন্ড”।

এই ট্রেন্ডের মূলভাব বা সারাংশ হলো ছবি তুলে অ্যাপের মাধ্যমে এডিট করলেই পেয়ে যাবেন আপনার কয়েক দশক পরের বৃদ্ধ বয়সের ছবি। বিষয়টা যে মজার এবং উপভোগ্য সে বিষয় নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। তাহলে এত বিশ্লেষণ কেন? কারণ আছে বলেই কলম ধরলাম।

দুটো জিনিষ ভাবিয়ে তুলছে। একটি সার্বজনীন, অন্য ভাবনাটি ব্যাক্তিগত। কোনটা আগে শুনবেন? সার্বজনীনটাই আগে বলি।

বেশ কয়েকমাস আগে আরেকটা “ট্রেন্ড” চলছিল, টেন ইয়ার্স চ্যালেঞ্জ।সে সময় লিখেছিলাম যে আপনার ছবি নিয়ে ডাটা অ্যানালাইসিস এর কারণে খোদ ফেসবুক এটা চালু করেছিল বলে গুঞ্জন ওঠে। এবারের বৃদ্ধ বয়সের ছবিও কি তাহলে ওরকম কিছু? এক অ্যামেরিকা আর কত ফরম্যাটে আমাদের ব্যক্তিগত তথ্য নেবে? গুগল, ফেসবুক….আরও কত কি!

নাহ্। এবারের খেলাটা অ্যামেরিকার নয়। লক্ষ্য করে দেখবেন, যে ফেসঅ্যাপ দিয়ে আপনি ছবি এডিট করছেন, সেটা কিন্তু ফেসবুকের সম্পত্তি না। থার্ড পার্টি বা আগন্তুক। অর্থাৎ, এবার আপনার তথ্যে নজর পড়েছে অন্য কারও। অন্য কোন দেশের। দেশটা রাশিয়া।

রাশিয়ার টেকজগতে শুরুর দিকে ক্ষুদ্র একটা স্টার্টআপ ছিল ফেসঅ্যাপ। এরপর ট্রেন্ডি হয়ে আকারে মোটাসোটা হয় সে। সেবার শুধু বুড়ো বয়স না, অন্য অনেক ফিল্টারের মাধ্যমে ছবি দেয়ার ট্রেন্ড ছিল।সেবারের ফেসঅ্যাপ ট্রেন্ডে বর্ণবাদী ইস্যু নিয়ে (স্কিন কালার এডিট) বিতর্ক দেখা দিলে অনেকটা নিরুদ্দেশই হয়ে যায় ফেসঅ্যাপ।

এবার মিছে বার্ধক্যের মোড়কে আবার হাজির ফেসঅ্যাপ। সবাই ছবি দিচ্ছে, আমাকেও দিতে হবে… এই ঝোঁক থেকেই তাড়াহুড়ো করে অ্যাপ নামাই আমরা। এরপর অ্যাপ কিছু পার্মিশন চায়। সেগুলো দ্রুততম সময়ে সারতে পারলেই যেন বাঁচি আমরা! প্রকৃতপক্ষে, এই জায়গাটাতেই আমরা অনুমতি দিয়ে দিচ্ছি আমাদের কল লগ, ব্রাউজিং হিস্ট্রি,মিডিয়া গ্যালারি সহ সবকিছুর। আর টার্মস অ্যান্ড কন্ডিশনে তো বলেই নিয়েছে…ফেসঅ্যাপ কর্তৃপক্ষ চাইলেই বাণিজ্যিক প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে আপনার ছবি ও তথ্য।

কেঁপে উঠলেন বোধ হয় একটু? ইচ্ছে করছে প্রতিক্রিয়াশীল হতে? অনেক দেরি ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে। তবে, শেষ হয়ে যায় নি সবকিছু। যাকে তাকে নিজের তথ্য ব্যবহারের অনুমতি দেবার আগে ভেবে নিন, ভুল হয়ে যাচ্ছে না তো?

অবশ্য অনেকে বলবেন, এ সিদ্ধান্ত আমার নিজের। আপনার নাক গলানোর প্রয়োজন নেই। হয়তো নেই। তবে, তথ্যও এখন আর আপনার নেই। ভেসে বেড়াচ্ছে দেশে দেশে।

এবার দ্বিতীয় চিন্তায় আসি। গতকালকেই আমার এক ফেসবুক বন্ধুর প্রোফাইলে বুড়ো বয়সের ছবি দেখে ভাবলাম ফেসঅ্যাপের কারসাজি। পরে খেয়াল হয়েছে তিনি সত্যি সত্যিই বয়সী! এখন বুড়ো মানুষ দেখলে ফেইক ছবি মনে হয়। মনকে বোঝাতে পারি না।

এসবের কারণে একটা বিষয় কিন্তু ভালো হয়েছে। আমরা সবাই আমাদের সত্যিকার রূপে আবির্ভূত হয়েছি।কিভাবে?

বার্ধক্য ছাড়া আর কোন অবস্থার সাথে মেলাবেন নিজেদের? মোবাইল জগতে তোলপাড় করা আমাদের বৈশিষ্টটা লক্ষ্য করুন। বার্ধক্যে যে জড়তা আসার কথা, তা এসে গেছে আগেই। ছোট-খাটো বিষয়ে প্রতিক্রিয়াশীল হওয়াটাও ওই বয়সের সাথে যায়, যার অর্থ হলো ধৈর্যের অভাব। সেই সাথে সামাজিক অন্যায়কে রুখে দাঁড়ানোর মতো সামর্থও যেন হারাতে চলেছি বুড়োদের মতই। তাই, ফেসঅ্যাপকে ধন্যবাদ আমাদের “সত্যিকারের সেলফি” বানিয়ে দেয়ার জন্য।

বিশ্বাস করুন, কিছুদিন পরেই এই ফেসঅ্যাপ ভুলে গা ভাসাবেন অন্য কোন ট্রেন্ডে। নতুন করে হুমকির মধ্যে ফেলবেন আপনার মুঠোফোনের তথ্যভান্ডারকে। সেদিন হয়তো ফেসঅ্যাপকে দেখে আপনি গেয়ে উঠবেন….

“আমি তো বুড়া না, বুড়া লইয়াই থাইকো”

সুরক্ষিত হোক তথ্যজালের জগতটাতে প্রতিটি পথচলা।

লেখক: সিনিয়র সহকারী সচিব, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।

কালের আলো/এআর/ডিএফ

Print Friendly, PDF & Email