নানা রূপে ফিরছে সোনালী আঁশ

প্রকাশিতঃ 11:55 pm | March 06, 2018

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো :

ছোটবেলায় পাটের রচনা মুখস্ত করা অনেকটা বাধ্যতামূলক ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য। প্রায় পরীক্ষাতেই এই রচনাটি আসত। রচনায় থাকত পাটকে বলা হয় সোনালী আঁশ। অথবা থাকত দেশের ৮০ শতাংশ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন হয় পাট থেকেই। এরপর বিংশ শতাব্দির শেষভাগ থেকেই পাটের বাজার পড়তে থাকে।

বিশ্ববাজারের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে পাট এক সময় হারিয়ে যায়। প্লাস্টিক পণ্যে ছেয়ে যায় বিশ্ব। পাটের কদর কমতে থাকে। পাল্টে যেতে থাকে বাংলাদেশের অর্থনীতির ধারাও। এখানে ধীরে ধীরে রপ্তানি আয়ে দখল নিতে থাকে তৈরি পোশাক খাত।

এখন বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় আসে তৈরি পোশাক থেকে। যা প্রায় ৮২ শতাংশ। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ হারায় তার সোনালী অতীত।

সম্প্রতি আবারো উদ্যোগ নেওয়া শুরু হয়েছে পাট নিয়ে। পাটের উৎপাদন বাড়ানো, পাটজাত পণ্যের বহুমুখীকরণ ও এসবের প্রদর্শনী নিয়ে নানা উদ্যোগ শুরু করেছে সরকার।

৯০ এর দশকেও পাটের ব্যবহার সীমাবদ্ধ ছিল চটের বস্তা, অল্প কিছু পাটের ব্যাগের মধ্যে। গত এক দশকে পাটের ব্যবহার বেড়েছে নানামুখী পণ্যে। পাট থেকে এখন পোশাক তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে শীতের জন্য নানা ধরণের জ্যাকেট তৈরি হচ্ছে। দেখে বোঝার উপায় নেই যে এসব পোশাক পাটের। একেবারেই নিখুঁত কাজের পোশাকগুলো পাওয়া যায় বিভিন্ন শোরুমেও।

পাট থেকে তৈরি হচ্ছে- শাড়ি, জামা, জুতা, স্যান্ডেল, ঘরের পর্দা, কুশন কাভার, টেবিল ম্যাট, টিস্যু বক্সসহ অনেক পণ্য। শুধু তাই নয়, পাট থেকে তৈরি হচ্ছে পলিথিন, সাইকেল। বলা যায়, দৈনন্দিন জীবনের অনেক কাজেই এখন ব্যবহার হচ্ছে পাটের। বহুমুখী পাটপণ্যের প্রদর্শনী ও বিক্রয় কেন্দ্র থেকে জানা গেছে, এ বছর পাট থেকে তৈরি হয়েছে ২৫০ ধরনের পণ্য।

পাটের পোশাক ডিজাইনার আমির হোসেন রঙ্গন জানান, সুতোর প্রধান কাঁচামাল পাট উৎপাদন হয় বাংলাদেশেই। তাছাড়া, এই পাটের তন্তু খুবই ভাল বলে সুতোর মান ভাল। এই সুতো দিয়ে নানা ধরনের পোশাক তৈরি করা যায়। তবে, শীতের জন্যই এই পোশাক বেশি উপযোগী বলে জানান তিনি।

তবে, শীতপ্রধান দেশে রপ্তানির জন্য পাটের সুতো নিয়ে আরো গবেষণা করা দরকার। এজন্য ল্যাবরেটরির প্রয়োজন বলে জানান আমির।

পাটকল করপোরেশন (বিজেএমসি) থেকে জানা গেছে, বিশ্বের প্রায় ৬০টি দেশে বাংলাদেশের পাট ও পাট পণ্যের চাহিদা রয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশেই রপ্তানি হচ্ছে বাংলাদেশের পাট পণ্য।

রপ্তানি উন্নয়ন বুরোর, সবশেষ তথ্যে দেখা গেছে, চলতি অর্থবছরের জুলাই-জানুয়ারি পর‌্যন্ত পাটের বিভিন্ন পণ্যে রপ্তানিতে আয় হয়েছে ৬৭ কোটি ২৯ লাখ ডলার। এর মধ্যে কাঁচাপাট সাড়ে ৯ কোটি ডলার, পাট সুতা ৪১ কোটি ৪৬ লাখ ডলার, পাটের বস্তা ও ব্যাগে ৯ কোটি ২৫ লাখ ডলার এবং অন্য পাটজাত পণ্য থেকে রপ্তানি আয় এসেছে ৭ কোটি ৩ লাখ ডলার।

পাট অধিদপ্তরের অতিরিক্ত সচিব শামসুল আলম বলেন, বাংলাদেশের পাট বিশ্বের সেরা। পাটের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে পাট বহুমুখীকরণের ওপরে।

তিনি বলেন, এক টন পাট বিক্রি করলে যে লাভ হয়। পাট পণ্য বিক্রি করলে লাভ হয় তার থেকে অনেক বেশি। এছাড়া, দেশ ও দেশের বাইরে বাইরে ব্যাপক চাহিদা থাকায় এখন পাট পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর জোর দেওয়া হচ্ছে।

সম্প্রতি পাট থেকে পলিথিন তৈরি করেছে পরমাণু গবেষণা কেন্দ্রের বিজ্ঞানীরা। তারা বলছে, পরিবেশ বান্ধব এই পলিথিন মাটিতে পচতে সময় নেবে ২ থেকে ৩ মাস। বাংলাদেশে ২০০২ সালে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে পলিথিনের ব্যবহার।

বন ও পরিবেশ দপ্তরের হিসেবে, প্রতিমাসে ঢাকায় পলিথিনের ব্যবহার হয় ৪১ কোটি। আর বছরে গোটা পৃথিবীতে ব্যবহৃত ১ ট্রিলিয়ন পলিথিনের কারণে প্রায় ১১ লাখ প্রাণী হুমকির মুখে পড়ে। তাই প্রাণী রক্ষায় এই পরিবেশ বান্ধব পলিথিন যে বড় কাজে আসবে তা বলাই যায়।

৬ই মার্চ দ্বিতীয়বারের মত জাতীয় পাট দিবস উদযাপন করেছে সরকার। দিবস ধরে বেশকিছু কর্মসূচি হাতে নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে পণ্যের বহুমুখীকরণের ওপর। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, হারিয়ে যাওয়া এই সোনালী আঁশকে ফিরিয়ে আনতে সম্ভাব্য সবকিছুই করা হচ্ছে।

 

কালের আলো/ওএইচ

Print Friendly, PDF & Email