শান্তিরক্ষা মিশনে সাফল্য-অন্তরায়ের কারণ বললেন সেনাপ্রধান

প্রকাশিতঃ 9:40 am | May 25, 2019

বিশেষ সংবাদদাতা, কালের আলো :

তিনি লেখক বা গবেষক নন। তবে অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ পরিপূর্ণ একজন মানুষ। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশন আনমিস’র ফোর্স কমান্ডারের সামরিক উপদেষ্টা হিসেবে ১৪ বছর আগে কাজ করার অভিজ্ঞতা এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে নিবিড় পর্যবেক্ষণে সহজাত, সহজবোধ্য আবার শক্তিশালী হয়ে উঠে তাঁর সন্দর্ভ (নিবন্ধ)।

আরো পড়ুন: হাওয়াইতে সিম্পোজিয়ামে সেনাপ্রধানের বক্তব্য নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন কালের আলোতে

এ সন্দর্ভে তিনি যেমন শান্তিরক্ষা মিশনের সাফল্যে কথা তুলে ধরেছেন তেমনি অকপট অন্তরায়ের বিষয়সমূহ নিয়েও। শান্তিরক্ষা মিশনের ভিনদেশীদের সঙ্গে বাংলাদেশের সেনা সদস্যদের কাজ করার বিচিত্র অভিজ্ঞতাকে ঘনিষ্ঠভাবে উপলব্ধি করতে পারেন তিনি।

তাদের আত্নত্যাগ, ভাষা, সংস্কৃতি, সমাজ, ভাবনা, জীবনবোধ বা আনুসঙ্গিক বিষয় কোন কিছুই বাদ যায়নি বহুমাত্রিক সৃজনশীল এ শীর্ষ সেনা কর্মকর্তার অবলোকনে। শান্তি মিশনে বাংলাদেশের ঐতিহাসিক পটভূমিকে বাস্তবতার আলোকে জীবন্ত করে তুলে ধরেছেন। সমস্যা যেমন চিহ্নিত করেছেন তেমনি সমাধানও দিয়েছেন।

বলা হচ্ছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি আন্তর্জাতিক সিম্পোজিয়ামে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদের উপস্থাপন করা একটি নিবন্ধ নিয়ে। মঙ্গলবার (২১ মে) হাওয়াইয়ের রাজধানী হুনুলুলুতে ‘ল্যান্ড ফোর্সেস অফ দ্যা প্যাসিফিক সিম্পাজিয়াম এবং এক্সপজিশন (লেনপেক) নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন তিনি।

আরো পড়ুন: সেনাবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধিকেই শান্তি অভিযানে সাফল্যের চাবিকাঠি মনে করেন সেনাপ্রধান

গুরুত্ব দিয়েই সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ‘বহুজাতিক পরিবেশে অন্য বাহিনীর সঙ্গে সঙ্গতি রেখে কার্যকরী শক্তি প্রয়োগের অন্যতম মৌলিক বিষয় হলো শান্তি অভিযান পরিচালনার পেছনের সমস্যাটি সম্পর্কে সম্যক ধারণা।

অভিযানের ধারণাটির যেখানে উদ্ভব, সেই শান্তি অধিদপ্তর (ডিপিও) থেকে শুরু করে বিভিন্ন পর্যায়ে সেনা প্রেরণকারী দেশগুলোর যথাযথ প্রতিনিধিত্বের অনুপস্থিতি যথাযথ সময়ে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর বাহিনীর প্রস্তুতিতে বিশেষ করে তাদের অস্ত্রসজ্জা এবং আন্ত-অভিযান সক্ষমতা ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।’

আরো পড়ুন: মুক্তিযুদ্ধ ও সেনাবাহিনীর আন্ত-অভিযানের সূচনার ইতিকথা জানালেন সেনাপ্রধান

তিনি বলেন, জাতীয় সামরিক পন্থাগুলোর মধ্যে বিদ্যমান পার্থক্যের কারণে উদ্ভূত ব্যবহারিক সমস্যা বহুজাতিক বাহিনীর বিশ্বাসযোগ্যতাকে প্রভাবিত করে। ব্যবহারিক ক্ষেত্রে নানা দেশের নিজস্ব সমর-দর্শন এবং আন্ত-অভিযান সক্ষমতার প্রতিকূল সমরাস্ত্র থেকে জাত বিচিত্র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কন্টিনজেন্টগুলোর মধ্যে সংহতির অভাব লক্ষ করা যায়।

তাছাড়া আত্নরক্ষা ও শান্তি অভিযানের মধ্যে অগ্রাধিকার নির্ণয়ে কন্টিনজেন্টগুলোর পার্থক্যও মাঝেমধ্যে সংহতির জন্য দারুণ সংকট তৈরি করে।

সেনাপ্রধান বলেন, মিশন এলাকায় অবস্থান নেওয়ার আগেই বাহিনীকে সম্মত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত করা বহুজাতিক পরিসরে সংহতির অন্যতম বড় সমস্যা। শান্তি অধিদপ্তরের (ডিপিও) সর্বস্তরে যথাযথ প্রতিনিধিত্বের অভাব সমস্যাটিকে আরও তীব্র করেছে।

এ সমস্যা মোকাবিলার উপায় হিসেবে শান্তি অভিযানে দীর্ঘ অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী আসন্ন শান্তি অভিযানে নিয়োজিত সাজসরঞ্জামের ধরন ও পরিমাণ মূল্যায়নের একটি দূরদৃষ্টিসম্পন্ন কাঠামো তৈরি করেছে।

আরো পড়ুন: ঐকতানেই মিশনের সাফল্য, দ্বন্দ্বে বিঘ্ন, বলছেন সেনাপ্রধান

এর মাধ্যমে পাওয়া পূর্বাভাস শান্তি অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে যতটা সম্ভব যাচাই করা হয়। এ প্রচেষ্টা সংক্ষিপ্ত সময়ে আমাদের কন্টিনজেন্টগুলোর আন্ত-অভিযান সক্ষমতা বাড়িয়ে সংশ্লিষ্ট অভিযান অঞ্চলে অবস্থান নিতে যথেষ্ট সমর্থ করে তুলেছে।

বহুজাতিক পরিসরে কাজের সাফল্যের চাবি কী, এমন বিষয়টি খোলাসা করে দেশের একমাত্র এ চারতারকা জেনারেল বলেন, একাধিক অংশীদারের সঙ্গে কার্যকরভাবে কাজ করার জন্য বিভিন্ন সংস্কৃতি সম্পর্কে পারস্পরিক বোঝাপড়া প্রয়োজন। বহুজাতিক পরিসরে কাজের সাফল্যের এটাই চাবি।

জাতি হিসেবে আমরা সমৃদ্ধ সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী। বহুজাতিক পরিবেশে আমাদের শান্তিরক্ষীরা তাই সহজাতভাবেই অন্য সংস্কৃতির প্রতি শ্রদ্ধাশীল থাকে। সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যের প্রতি উঁচু মাত্রার শ্রদ্ধা দেখিয়ে আমরা স্থানীয় জনগণ এবং মিশনে কর্মরত অন্য দেশের বাহিনীর মন জয়ের চেষ্টা করি। এটি মিশন এলাকার সামাজিক নির্মাণের সমস্যা কমিয়ে আনে।

আরো পড়ুন: বিশ্ব শান্তিরক্ষায় বাংলাদেশের কর্মতৎপরতা লাল-সবুজের পতাকার সুনামের স্মারক, বললেন সেনাপ্রধান

আন্ত-অভিযানে সমস্যাসমূহের সমাধান দিয়ে বেশ কিছু সুপারিশও করেন সেনাবাহিনী প্রধান। তিনি বলেন, আন্ত-অভিযান সক্ষমতার ক্ষেত্রে ফাঁকফোকর শনাক্ত করা এবং তা সংশোধনের কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার সঠিক পন্থা হলো যৌথ অভিযানের আয়োজন।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিভিন্ন দেশের সহযোগিতায় যৌথ অভিযানের আয়োজন করছে, তবে তা অপ্রতুল। ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় বাহিনীগুলোর মধ্যে আন্ত-অভিযান সক্ষমতা বাড়াতে নিয়মিত বিরতিতে আরও যৌথ প্রশিক্ষণ অভিযানের পরিকল্পনা নেওয়া যায়।

ঐক্যবদ্ধ সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রামে গড়ে উঠা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এ প্রধান বলেন, উন্নয়নশীল দেশের সেনাবাহিনীর সামর্থ্য বাড়াতে প্রযুক্তি হস্তান্তর, জ্ঞান ভাগাভাগি, বর্ধিত বিনিময় কর্মসূচি এবং যুদ্ধ ছাড়া অন্যান্য অভিযানে সহযোগিতা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।

আরো পড়ুন: বিশ্বমঞ্চে শান্তিরক্ষায় নিজের অভিজ্ঞতার গল্প শুনালেন সেনাপ্রধান

প্রযুক্তির বিচারে উন্নত দেশের চেয়ে উন্নয়নশীল দেশের সেনাবাহিনী পিছিয়ে আছে। উন্নয়নশীল দেশের প্রযুক্তিগত আন্ত-অভিযান সক্ষমতা বাড়াতে প্রযুক্তি হস্তান্তর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

স্বতন্ত্র গুণের অধিকারী জেনারেল আজিজ আহমেদ বলেন, ইন্দো-প্রশান্ত মহাসাগরীয় দেশগুলোর মধ্যে বিদ্যমান প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে উন্নত সহযোগিতা আন্ত-অভিযান সক্ষমতা বাড়ানোয় সহায়ক হতে পারে।

যৌথ সেমিনার, অনুষদ বিনিময়, প্রশিক্ষণ প্যাকেজ বিনিময়, গবেষণা ও উন্নতির বিষয় আদান-প্রদান হতে পারে এই সহযোগিতার ক্ষেত্র। আন্ত-অভিযান সক্ষমতার ওপর জোর দিলে শান্তি ও যুদ্ধ উভয় ধরনের অভিযানের জন্যই তা বাহিনীকে প্রস্তুত করবে।’

কালের আলো/এএ/এএএএমকে

Print Friendly, PDF & Email