আইএস জঙ্গিরা বাংলাদেশে ফিরছে?

প্রকাশিতঃ 7:42 pm | May 07, 2019

কালের আলো ডেস্ক:

সিরিয়া ফেরত একজন সন্দেহভাজন জঙ্গি সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর রিমান্ডে নিয়েছে ঢাকার কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। ওই ব্যক্তি এ বছরের ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশে প্রবেশের পর জঙ্গি তৎপরতার পরিকল্পনা করছিল বলে পুলিশ জানিয়েছে।

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত এরকম অন্তত ৫০ জন বিভিন্ন দেশ থেকে গিয়ে সিরিয়া আর ইরাকে আইএসের সঙ্গে জড়িত হয়েছিল, যাদের ফরেন টেরোরিস্ট ফাইটার বলে বর্ণনা করছেন কর্মকর্তারা।

সিরিয়া ও ইরাকে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট বা আইএস খিলাফত প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়ার পরে বিশ্বের অনেক দেশ থেকে নাগরিকরা তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছিল। সেই তালিকায় বাংলাদেশ থেকে যাওয়া ব্যক্তিরা যেমন রয়েছে, তেমনি বিদেশে জন্ম নেয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত নাগরিকরাও রয়েছে।

দখলকৃত এলাকা থেকে আইএস উৎখাত হয়ে যাওয়ার পরে এই বিদেশি জঙ্গিরা বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। এরকমই একজনকে রবিবার গ্রেপ্তার করেছে বাংলাদেশের গোয়েন্দারা।

বিদেশফেরত আইএস জঙ্গিদের ঠেকাতে বাংলাদেশ কতটা প্রস্তুত?
সিটিটিসির উপ পুলিশ কমিশনার মহিবুল ইসলাম খান বিবিসি বাংলাকে বলছেন, এই তালিকাটি ইমিগ্রেশনে দেয়া আছে। ফলে তারা বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করলেই আমরা জানতে পারবো।

যদিও এই তালিকার অনেকেই সিরিয়া বা ইরাকে যুদ্ধ করতে গিয়ে মারা গেছেন বলে বাংলাদেশের গোয়েন্দা কর্মকর্তারা ধারণা করছেন।

সিটিটিসির গ্রেপ্তারকৃত এই সন্দেহভাজন জঙ্গি সৌদি আরবে জন্মগ্রহণ করেন। সেখানকার দূতাবাস থেকে পাসপোর্ট গ্রহণ করে তিনি সিরিয়ায় গিয়ে আইএসের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন।

হলি আর্টিজান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী হিসেবে অভিযুক্ত বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডিয়ান নাগরিক তামিম চৌধুরী সিরিয়া-ইরাকে গিয়েছিলেন বলে জানা যায়। ২০১৪ সালে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত একজন ব্রিটিশ নাগরিককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ, যিনি আইএসের জন্য সদস্য সংগ্রহ করছেন বলে পুলিশ জানিয়েছিল।

জঙ্গি কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষক তাসনিম খলিল বলছেন, বাংলাদেশ থেকে যারা সিরিয়া বা আইএসে যোগ দিতে যারা গিয়েছেন, তাদের সম্পর্কে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে তথ্য আছে, তারা হয়তো তাদের প্রবেশ ঠেকাতে পারবেন।

‘কিন্তু বিদেশে জন্ম নেয়া যেসব বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্যক্তিরা যুদ্ধ করতে বা আইএসে যোগ দিয়েছেন, অথচ তাদের সম্পর্কে বাংলাদেশি সংস্থাগুলোর কাছে তেমন তথ্য নেই, তাদের ক্ষেত্রে আসলে তারা কতটা কী করতে পারবেন?’

তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, এই যে ব্যক্তিকে নিরাপত্তা বাহিনী আটক করেছে, তিনি ১ ফেব্রুয়ারিতে প্রবেশ করে গত তিন মাস ধরে কিন্তু বাংলাদেশে তার কর্মকাণ্ড চালিয়েছেন। জঙ্গি মিটিং করার সময় তাকে আটক করার কথা বলা হচ্ছে, অর্থাৎ তিনি এতদিন ধরে নির্বিঘ্নে তার তৎপরতা চালিয়ে গেছেন। এরকম আরও অনেকে থাকতে পারে,যাদের কথা হয়তো এখনো নিরাপত্তা বাহিনী জানে না।

জঙ্গি কর্মকাণ্ডের এই গবেষক বলছেন, ‘এক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য একটি বিশাল ঝুঁকি তৈরি হয়েছে। কারণ যেসব জিহাদিদের আমরা চিনি না বা ছদ্মনামে রয়েছে, তারা অন্য নামে পাসপোর্টে এলে তাৎক্ষণিকভাবে ধরার কোন উপায় নেই।’

‘ফলে বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর আরও নিবিড় ব্যবস্থা নেয়া উচিত, যাতে এ ধরনের কেউ বাংলাদেশে এসে সক্রিয় হওয়ার ওঠার আগেই ব্যবস্থা নেয়া যায়।’

সিটিটিসি কর্মকর্তা মহিবুল ইসলাম খান বলছেন, ‘এটি আমাদের জন্য অবশ্যই একটি চ্যালেঞ্জ, তবে এ বিষয়ে আমরা সতর্ক আছি। এই সমস্যা মোকাবেলায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, যা আমরা ঘোষণা করতে চাই না।’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলছেন, জঙ্গি কর্মকাণ্ড মোকাবেলায় বিদেশি কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে বাংলাদেশের নিয়মিত যোগাযোগ ও তথ্য আদান-প্রদান হচ্ছে।

সিরিয়া ফেরত এই ব্যক্তিতে গ্রেপ্তারের ক্ষেত্রেও বাইরের গোয়েন্দা সংস্থার কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গিয়েছিল বলে জানা গেছে।

২০১৬ সাল থেকেই সিরিয়া বা ইরাকে আইএস কোণঠাসা হতে শুরু করে। এখন তারা সর্বশেষ ঘাটিগুলোও হারিয়েছে।

জঙ্গি কর্মকাণ্ড বিশ্লেষক তাসনিম খলিল বলছেন, ‘সিরিয়া ও ইরাকে নিজেদের অবস্থান হারিয়ে আইসিস এখন বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে হামলার নীতি নিয়েছে।’

‘বাগদাদীর সর্বশেষ ভিডিওতে দেখা গেছে, যে আইসিস এখন সিরিয়া ও ইরাকের বাইরে পাঁচ ছয়জন মিলে হামলার নীতি নিয়েছে। এখানে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নতুন একজন আমির নিয়োগ দেয়া হয়েছে। গুলিস্তানে পুলিশের ওপর আইইডি হামলার ঘটনাটি তাদের নতুন করে সক্রিয় হয়ে ওঠার একটি উদাহরণ। ফলে বোঝা যাচ্ছে তারা বাংলাদেশে নতুন করে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে। ফলে আমাদের আরো বেশি সতর্ক হওয়ার প্রয়োজন আছে।’

শ্রীলঙ্কায় ইস্টার সানডের দিনে আটটি স্থানে হামলা চালিয়ে কয়েকশ মানুষকে হত্যার দায় স্বীকার করেছে আইএস গ্রুপ। ফলে এই গ্রুপের জিহাদিরা যে বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে, তার ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

অনেকে ইউরোপিয়ান দেশগুলোয় ফিরে গেছেন। সেখানে তাদের নজরদারিতে রাখা হয়েছে, কিন্তু তাদের নিয়ে উদ্বেগে রয়েছে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো।

তাসনিম খলিল বলছেন, ‘সিরিয়ায় সর্বশেষ ঘাঁটি হারিয়ে যারা বন্দী হয়েছেন, তাদের অনেকে দেশে ফিরতে চান, অনেকে ফিরতে চান না। তবে যারা যোদ্ধা, তারা হয় আফগানিস্তানের মতো কোনো দেশে আবার যুদ্ধ করতে যাবে, না হলে যেকোনোভাবে তারা বাংলাদেশে ফেরত আসতে চাইবে এবং এখানে কিছু করার চেষ্টা করবে।’

বাংলাদেশের আইন কী বলছে?
সম্প্রতি বিবিসি বাংলার সঙ্গে একটি সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলছেন, তথাকথিত ইসলামিক স্টেটের জিহাদি বধূ শামীমা বেগম যদি বাংলাদেশে গিয়ে হাজির হয়, তাহলে তার মৃত্যুদণ্ড হবে।

মোমেন বলেন, সন্ত্রাসের প্রশ্নে বাংলাদেশ ‘জিরো টলারেন্স’ বা একেবারেই বরদাশত না করার অবস্থান নিয়েছে।

বাংলাদেশের সন্ত্রাস বিরোধী আইন (সংশোধন) ২০১৩- এ বলা হয়েছে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি কোনো বিদেশি রাষ্ট্রে অপরাধ করে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়, যা বাংলাদেশে সংঘটিত হলে এই আইনের অধীন শাস্তিযোগ্য হতো, তাহলে ওই অপরাধ বাংলাদেশে সংঘটিত হয়েছে বলে গণ্য হবে।’

সেখানে আরও বলা হয়েছে, ‘সেই সঙ্গেই এবং যদি তাকে ওই অপরাধ বিচারের এখতিয়ার সম্পন্ন কোনো বিদেশি রাষ্ট্রে বহিঃসমর্পণ করা না যায়, তাহলে ওই ব্যক্তি ও অপরাধের ক্ষেত্রে এই আইনের বিধানাবলী প্রযোজ্য হবে।’

সেই সঙ্গে জাতিসংঘ কনভেনশনে বর্ণিত কোন অপরাধে জড়িত থাকলেও এই আইনে দোষী হবে। অর্থাৎ বিদেশে অপরাধ করে কেউ বাংলাদেশে আসলে, সেই অপরাধে বাংলাদেশে যে শাস্তি হতো, সেই একই শাস্তি প্রযোজ্য হবে।

এক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ড অথবা যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং অতিরিক্ত অর্থদণ্ড হতে পারে।

এছাড়া অভিযুক্ত ব্যক্তির স্বীকারোক্তি রেকর্ড সম্পর্কিত বিশেষ বিধান, তদন্ত কালীন সন্ত্রাসী সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা বিধানও এই বিলে সংযোজনের প্রস্তাব করা হয়েছে।

-বিবিসি বাংলা

Print Friendly, PDF & Email