‘জীবনে অত আনন্দ আগে কখনো পাইনি’

প্রকাশিতঃ 9:12 pm | February 12, 2018

জুয়েল আইচ:

নিজেকে নিজে প্রতারক ভাবার মত শাস্তি আর কিছুতেই নেই। অমন ভয়াবহ শাস্তি আমার একবার হয়েছিল। অনেক দিন আগের কথা। বাংলাদেশের কোন জেলা শহরে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অডিটরিয়াম তখন ছিল না।

সিলেট অডিটরিয়ামের চাল টিনের। জুলাই মাস। সারাদিন সূর্যের ভয়ংকর তাপে বিকেল নাগাদ তা উনুনের মত উত্তপ্ত হয়ে উঠলো। হল দর্শকে ঠাসা। তখন ৩০ হাজার ওয়াট লাইট জ্বালিয়ে শো করতাম। উদ্দেশ্য, সবচেয়ে দূরের দর্শকও যেন সব জাদু দিনের আলোর মতো ঝকঝকে স্পষ্ট দেখতে পান। সব লাইট আমার দিকে তাক করা।

অনুষ্ঠান শুরুর পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তাপে কাবাব হয়ে গেলাম। মগজ হল কঠিন সিদ্ধ ডিম। ১০ মিনিটের মধ্যে কড়া ভাজা কৈ মাছ। হিট স্ট্রোকে যেকোনো সময় মঞ্চে পড়ে যাবো। তিন ঘণ্টার শো। সামনে হাজার মানুষ। পাঁচশো আর হাজার টাকা দামের টিকেট কিনে দর্শক হলে ঢুকেছেন। উনিশশো আশি সালের হাজার টাকা। ওরে বাপরে!

এক একটা ম্যাজিক করি আর মনে হয়, এক একটা মুক্তিযুদ্ধ শেষ করেই আরেকটা যুদ্ধে ঢুকে পড়লাম। কি ভয়ংকর! এক একটা মিনিট পাস করতেই জীবন সংহার। তিন ঘণ্টা চালাবো কি করে! ম্যাজিক বলে কথা। সামান্য ভুল হলেই এক হাজার মানুষ আমায় ছিঁড়ে খাবে। মাথা আউট। শরীর অসাড়। তীব্র আলোর তেজে চোখ অন্ধ।

অবশেষে একসময় জীবন্ত আগ্নেয়গিরির লাভা-সমুদ্র যেন সাঁতরে পার হলাম। একটু বাতাসের আশায় বাইরে বের হচ্ছি। দেখি সমস্ত হল ঘরের মেঝেতে দু’তিন ইঞ্চি পানি থৈথৈ করছে।

এত পানি কেন? আমার অবাক প্রশ্ন ।
সমস্বরে উত্তর, দর্শকদের ঘাম।
বলেন কি! এ দেখি পুকুর।
আমাকে কয়েক জন ধরে হলের বাইরে নিয়ে এল।
নিজেকে একজন ভয়ংকর অত্যাচারী প্রতারক মনে হতে লাগলো। মন মাতানো আনন্দের মিথ্যে প্রত্যাশা জাগিয়ে এতগুলো মানুষকে এমন ভয়াবহ অত্যাচার করলাম!
আমি হিটলারের চেয়েও নিষ্ঠুর। আমি ক্ষমার অযোগ্য এক প্রতারক।
সে স্মৃতি আজও আমায় দুঃস্বপ্নের মত তাড়া করে ফেরে।
আজ একটা কাণ্ড ঘটে গেছে। সকালে ফেসবুকে চোখ পড়লো। সিলেটের সেই শো’র একজন দর্শক জীবন্ত বিভীষিকার মতো আমার চোখের সামনে। আমার বুক কেঁপে উঠলো।

মুহাম্মদ নুরুজ্জামান নুরুল ফেসবুকে লিখেছেন- ‘বহুদিন আগে সিলেট অডিটরিয়ামে আপনার অনুষ্ঠান দেখার জন্য অনেক কষ্ট করে পাঁচশ’ টাকা জোগাড় কররেছিলাম।তখন ছাত্র ছিলাম। দুইটা টিউশনি করে মাসে মাত্র চারশ’ টাকা পেতাম। আরও একশো টাকা ঋণ করে তখন পাঁচশ’ টাকার টিকেট কিনেছিলাম। সারাটা মাস অর্ধাহারে অনাহারে, অসুস্থ কাটিয়েছি।’

ব্যস। ওইটুকুই। আমার সারাটা দিন আজ দোযখের আগুনে ছটফট করেছি। মাঝে মাঝে ফেসবুক খুলে তাঁর শেষ অভিযোগ অভিশাপগুলো পড়তে চাইছিলাম। না আর কিছুই তিনি বলছেন না। সারা দিন শেষে এখন হঠাৎ আবার তাঁর লেখা।

” দুঃখিত। জরুরি কাজে বাইরে যেতে হয়েছিল। হ্যাঁ, যা বলছিলাম, সেদিন পাঁচশ’ টাকার টিকেট মূল্যের বিনিময়ে যে আনন্দ পেয়েছিলাম, এখন হয়তো পঞ্চাশ হাজার টাকায়ও তা পাবো না।

জীবনে অত আনন্দ আগে কখনো পাইনি আর কখনো পাবো বলেও আশা রাখি না। আপনি আমার আজীবনের হিরো।’

জীবনে এর চেয়ে আনন্দ আশা করা কি ঠিক?

 

(ফেসবুক থেকে সংগৃহীত)

Print Friendly, PDF & Email