মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স

প্রকাশিতঃ 9:13 pm | February 02, 2019

মো. জামাল উদ্দিন আহমেদ ::

মাদক আমাদের দেশে তিনশ’ বছরের একটি পুরনো সমস্যা। ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে যে যুদ্ধ হয়েছিল; ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির ভারতবর্ষে আধিপত্য করার মূল কারণ ছিল মাদক ব্যবসা।

জঙ্গি ও মাদক- রাষ্ট্রের এ দুটি বড় সমস্যা। জঙ্গি মোকাবেলায় বলা যায়, সরকার অনেকাংশেই সফল। কিন্তু মাদকের ক্ষেত্রে আমাদের যেভাবে সফল হওয়ার কথা ছিল সেভাবে পারছি না- এই বাস্তবতাকে আমাদের স্বীকার করতে হবে। মাদক নিয়ন্ত্রণে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর যে নিয়ন্ত্রণের কথা বলছে, তারা তা কতটুকু করতে পারছে, তাদের সক্ষমতা কতটুকু কিংবা তাদের কী কী কাজ করা প্রয়োজন, কী কী কাজ করছে; এ বিষয়গুলো বিশ্নেষণ করলে দেখা যায়, তাদের সক্ষমতার ক্ষেত্রটা প্রাতিষ্ঠানিকভাবে একেবারেই কম।

প্রায় ২১৭ কিলোমিটারের সীমানা হচ্ছে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমারের সঙ্গে। তার মধ্যে ৬৩ কিলোমিটার হচ্ছে জলপথ, বাকিটা স্থলপথ। মাদক একেক সময় তার রূপ বদলায়। আজকের যে মাদকটাকে ইয়াবা বলছি, সময়ের বিবর্তনে এই ইয়াবা আরেক নামে আসবে। একসময় ফেনসিডিল ছিল ব্যাপক প্রচলিত মাদক এবং তার ছিল রমরমা ব্যবসা। তারও আগে মদ, আফিম, কোকেন, গাঁজা, হেরোইন ইত্যাদি ছিল। যদিও হেরোইন এখনও অত্যন্ত লাভজনক মাদক। অর্থাৎ এখন যে মাদকগুলো বন্ধ আছে তা কিন্তু নয়। ভিন্ন নামে এগুলো আসছে। ফেনসিডিল যতটুকু লাভজনক ব্যবসা, বহন করতে যতটুকু কষ্ট; এর চেয়ে ইয়াবা অনেক সহজ। ইয়াবা এত ছোট ট্যাবলেট, খুব সহজেই বহন করা যায়। ইয়াবা আসে মূলত মিয়ানমার থেকে। আর এটা প্রমাণিত- মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এই মাদক ব্যবসায় সরাসরি যুক্ত।

সবাই জানি, মাদক বিশেষ করে ইয়াবা আসার রাস্তা কোনটি। প্রশ্ন আসতে পারে, তাহলে আমরা বন্ধ করতে পারছি না কেন? ঢাকা-কক্সবাজার, ঢাকা-চট্টগ্রাম, টেকনাফে প্রচুর গাড়ি চলাচল করছে। এভাবেই কোনো না কোনো মাধ্যমে মাদক মিয়ানমার থেকে আমদানি হচ্ছে। ধরা যাক, টেকনাফ বর্ডার কন্ট্রোল করা হলো। তখন দেখা গেল নদীপথে সেটা পটুয়াখালী বা অন্য পথে দেশের অন্যত্র চলে যাচ্ছে। বিশাল সমুদ্রে সব নৌকা চেক করার সুযোগ আসলে আমাদের নেই। তা ছাড়া মাদক কার কাছে আছে, কে পরিবহন করছে, কোন পথে যাচ্ছে, বাইরে থেকে বোঝার কোনো উপায় বা সুযোগ নেই। তাই অনেক সময় আমরা নিরুপায়।

একটা ইয়াবা ট্যাবলেটের দাম মিয়ানমার বা টেকনাফের সীমান্ত এলাকায় ২০, ৩০, ৪০; সর্বোচ্চ ৫০ টাকা পর্যন্ত। সেই ট্যাবলেট ঢাকায় বা এর আশপাশে বিক্রি হয় ২৫০, ৩০০, ৪০০ টাকায়। অনেক সময় এরও বেশি। বোঝাই যাচ্ছে, কত গুণিতক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অবাক করার মতো বিষয়, এই মাদক সরবরাহ বা পরিবহনে শিশু ও নারীরা যুক্ত হচ্ছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, একজন ছাত্র নিজে নিজে কখনোই ইয়াবা-মাদকাসক্ত হয় না। এটি হয় প্রায় শতভাগ বন্ধু-বান্ধবের প্ররোচনায়। কারণ একটি ইয়াবার দাম যেখানে ২৫০ বা ৩০০ টাকা; জোগাড় করা একজন ছাত্রের পক্ষে সবসময় সম্ভব না। তখন মায়ের কাছ থেকে, কখনও বাবার পকেট থেকে চুরি করতে করতে একসময় সে ছিনতাই ও বিভিন্ন অপরাধমূলক কাজে জড়িয়ে যাচ্ছে। এমনকি সে নিজেই মাদক ব্যবসায়ী হয়ে যাচ্ছে। এটা এমন এক রাস্তা, ইচ্ছা করলেও সেখান থেকে বেরিয়ে আসার সুযোগ নেই।

যে হারে মাদক নতুন প্রজন্মকে আক্রমণ করছে, এখনই তা নিয়ন্ত্রণ করা না হলে আরও বেশি মাত্রায় বাড়তে থাকবে, যা ঠেকানো দুরূহ হয়ে পড়বে। এটাকে বন্ধ করতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর অথবা এই ফোর্সমেন্টের সঙ্গে যারা যুক্ত, যেমন পুলিশ, কোস্টগার্ড, র‌্যাব, বিজিবি বা অন্যান্য বাহিনীর পক্ষে সম্ভব নয়। সমাজে এককভাবে যেমন একজন মানুষ বাস করতে পারে না, তার প্রয়োজন রয়েছে সবার। তেমনি সমাজ থেকে মাদক তাড়াতে হলে সবাইকে এক হতে হবে।

বর্তমানে বাংলাদেশে কতজন মাদকাসক্ত আছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এটা বের করা অত্যন্ত কঠিন। কেউ তো স্বীকার করবে না- আমি মাদকাসক্ত। তার পরও একটা পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, দেশে ৭০ লাখের মতো মাদকাসক্ত রয়েছে। এর মধ্যে ৭৪ শতাংশ হচ্ছে ছেলে ও ২৬ শতাংশ মেয়ে। গবেষণায় দেখা গেছে, মাদকাসক্তদের মধ্যে ৯৮ শতাংশ ব্যক্তিরই প্রাথমিক ধাপ সিগারেট।

২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়, ২০৩০-এর মধ্যে ক্ষুুধা-দারিদ্র্যমুক্ত এবং ২০৪১- এর মধ্যে উন্নত দেশের তালিকায় থাকবে বাংলাদেশ। কিন্তু সে যাত্রায় আমরা যেভাবে এগোচ্ছি সেভাবে সম্ভব নয়; যদি বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান ও সম্ভাবনাময় যুবসমাজকে সঠিকভাবে কাজে লাগানো না যায়, বিশেষ করে মাদক নির্মূল করা না যায়। তাহলে আমাদের সরকারের ভিশন-২০২১ এবং রূপকল্প-২০৪১ কতটুকু সম্ভব, তা বলা কঠিন। যদিও প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ইতিমধ্যে বিভিন্ন কর্মসূচি সফলতার মুখ দেখছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর কাজগুলো টেবিল-চেয়ারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখছে না। সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের অভিমত নিচ্ছে। বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যাচ্ছে, মসজিদের ইমামদের যুক্ত করছে মাদকবিরোধী প্রচারণায়। অর্থাৎ সমাজের প্রত্যেক ক্ষেত্রে কাজ করে যাচ্ছে। মাদকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা গড়ে তুলতে ইতিমধ্যে ‘জীবনকে ভালোবাসুন, মাদক থেকে দূরে থাকুন’- এ স্লোগানে তথ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় মাদকের ভয়াবহতা থেকে আগামী প্রজন্মকে রক্ষায় মাদকের বিরুদ্ধে তথ্য অভিযান শুরু হয়েছে। পাশাপাশি আমরা একটি ব্যানার তৈরি করেছি, যেখানে মাদকের কুফল তুলে ধরা হয়েছে। আমার দৃঢ়বিশ্বাস, এটি একবার দেখলে মাদক সম্পর্কে ঘৃণা তৈরি হবেই। এ ছাড়া মাদকবিরোধী সভা-সমাবেশ, র‌্যালি, হাটেঘাটে মাদকবিরোধী নাটক ও জনসমাবেশ নিয়মিত করে যাচ্ছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মাদকবিরোধী ক্যাম্পেইন সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে। এ থেকে ভালো সাড়াও পাওয়া যাচ্ছে।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর নিয়মিত বিভিন্ন অভিযান পরিচালনা এবং মাদক ব্যবসায়ীদের চিহ্নিতও করছে; কিন্তু রুখতে পারছে না। কারণ তাদের বিভিন্ন রূপ ও পরিচয় আছে। যেমন রাজনৈতিক রূপ, সামাজিক রূপ, ব্যবসায়িক রূপ এমনকি প্রশাসনিক রূপও আছে। এটা বন্ধ করতে হলে সবাইকে একতাবদ্ধ হয়ে এগিয়ে আসতে হবে।

ইদানীং শহরের নামিদামি এলাকায় নতুন একটি মাদকের নাম ‘সিসা বার’। ইতিপূর্বে আইন নেই বিধায় এই সিসা বারের বিরুদ্ধে আমরা কিছু করতে পারছিলাম না। আশার কথা, ইতিমধ্যে মৃত্যুদণ্ডের বিধান রেখে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন, ২০১৮ পাস হয়েছে। ‘কোনো ব্যক্তি ৫ গ্রাম পরিমাণের বেশি ইয়াবা, অন্যদিকে হেরোইন, সিসা বা কোকেনের ক্ষেত্রে ২৫ গ্রামের বেশি বহন, সেবন, বিপণন, মদদদান ও পৃষ্ঠপোষকতা করলে তার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ শাস্তি যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বা মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। তবে যদি এর পরিমাণ ৫ গ্রামের নিচে হয়, তাহলে সর্বনিম্ন শাস্তি এক বছর এবং সর্বোচ্চ শাস্তি ৫ বছর কারাদণ্ড। এর সঙ্গে অর্থদণ্ডেও দণ্ডিত করা যাবে।’ যদিও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৯০-এ মাদক অপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড ছিল। বিগত আইনে কোনো ব্যক্তির দখল, কর্তৃত্ব বা অধিকারে মাদকদ্রব্য না পাওয়া গেলে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের সুযোগ নেই। ফলে মাদক ব্যবসায় জড়িত মূল পরিকল্পনাকারীরা সহজেই পার পেয়ে যায়। নতুন আইনে মাদক ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষক ও মাদকের গডফাদারসহ মাদক সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। আইনে মাদক ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষকতাকারী কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকেও আইনের আওতায় আনার লক্ষ্যে মানি লন্ডারিং সংক্রান্ত অপরাধ তদন্তে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ক্ষমতায়িত করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মাদকের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ঘোষণা করেছেন। এটা বাস্তবায়নে সবার সহযোগিতা একান্ত কাম্য। এ ক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্মকে সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে।

তরুণ প্রজন্মকে বলতে চাই; ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি এ পি জে আবদুল কালাম বলেছেন, স্বপ্ন মানে হচ্ছে আমরা রাতে ঘুমের মধ্যে যেটা স্বপ্ন দেখি সেটা নয়। যেটা অর্জন করার জন্য আমার ঘুমকে নষ্ট করে সেটাই স্বপ্ন। আমরা সেই স্বপ্ন দেখতে চাই। এটাই আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে সুযোগ সৃষ্টি করবে। মাদক নিয়ন্ত্রণে মাদকবিরোধী প্রচারণায় সবাই ভূমিকা রাখবে এবং সরকারের একজন দূত হিসেবে সবাই কাজ করবে। তাহলেই জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান যে সুখী-সমৃদ্ধ দেশের স্বপ্ন দেখেছিলেন, তা পাওয়া সম্ভব হবে।

মহাপরিচালক, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর

Print Friendly, PDF & Email