আরাকান আর্মির হামলায় মিয়ানমারে ৭ পুলিশ নিহত

প্রকাশিতঃ 8:28 pm | January 04, 2019

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলো:

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে পুলিশের চারটি চেক পোস্টে হামলা চালিয়ে সাত পুলিশ সদস্যকে হত্যা করেছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আরাকান আর্মি। শুক্রবার মিয়ানমারের স্বাধীনতা দিবসে এ হামলা হয় বলে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এবং ওই সশস্ত্র বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। খবর রয়টার্স।

জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনীর সাম্প্রতিক লড়াইয়ে গেল বছর শেষ নাগাদ আড়াই হাজার বেসামরিক নাগরিক বাস্তুচ্যুত হয়েছে।

আরাকান আর্মির মুখপাত্র খাইন থু খা রয়টার্সকে বলেছেন, তাদের সদস্যরা চারটি পুলিশ পোস্টে আক্রমণ করেছে এবং পরে সাত ‘শত্রুর’ মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে।

মিয়ানমার নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ জন সদস্যকে আটক করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেব। আমরা তাদের ক্ষতি করব না।

আরাকান আর্মির মুখপাত্র বলেন, সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে তাদের সদস্যদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর আগ্রাসনের জবাবে এই হামলা চালানো হয়েছে।

এর আগে একই এলাকায় সংখ্যালঘু বৌদ্ধ রাখাইনদের আরও অধিকারের দাবিতে লড়াইরত আরাকান আর্মির সঙ্গে মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তুমুল সংঘর্ষ হয় ডিসেম্বরের প্রথম দিকেও।

প্রসঙ্গত, মিয়ানমারের উত্তরাঞ্চলীয় রাখাইন প্রদেশে দেশটির সেনাবাহিনীর ‘ক্লিয়ারেন্স অপারেশন’-এ প্রায় ৯০ শতাংশ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালাতে বাধ্য হয়েছেন। গত আগস্টে রাখাইনে রোহিঙ্গা নিপীড়ন শুরুর আগে সেখানে ৭ লাখ ৬৭ হাজার ৩৮ জন রোহিঙ্গা ছিল।

বর্তমানে রাখাইনে মাত্র ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৭৯ হাজার ৩৮ জন রোহিঙ্গা রয়েছেন। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক সমন্বয়ক সংস্থা (ইউএনওসিএইচএ) ও রাখাইনের স্থানীয় প্রশাসনের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে মিয়ানমারের স্থানীয় দৈনিক দি ইরাবতি এক প্রতিবেদনে শনিবার এ তথ্য জানিয়েছে।

দি ইরাবতি বলছে, গত বছরের ২৫ আগস্ট রোহিঙ্গাদের ওপর সেনাবাহিনীর হামলার পর রাখাইনের উত্তরাঞ্চলের মুসলিম অধ্যুষিত মংডু, বুথিডং ও রাথেডং শহর থেকে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ঢল নামে। বাংলাদেশে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গারা রাখাইনে নিরাপত্তা বাহিনীর ধর্ষণ, হত্যা, অগ্নিসংযোগের অভিযোগ করছেন।

মংডু, বুথিডং ও রাথেডং শহরের সাধারণ প্রশাসনিক বিভাগ (জিএডি) ও ইউএনওসিএইচএর সর্বশেষ তথ্য বিশ্লেষণে রাখাইনে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের পরিসংখ্যান তৈরি করেছে ইরাবতি। মিয়ানমারের সেনা নিয়ন্ত্রিত স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ করে জিএডি। স্থানীয় প্রশাসনের তৈরি রাখাইনের রোহিঙ্গা পরিসংখ্যানে ২০১৭ সালের অক্টোবর পর্যন্ত হিসাব রাখা হয়েছে।

জিএডির তথ্য পর্যালোচনা করে ইউএনওসিএইচএ বলছে, গত বছরের ২৫ আগস্ট থেকে চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে নতুন করে ৬ লাখ ৮৮ হাজার রোহিঙ্গার নিবন্ধন হয়েছে। এ ছাড়া মিয়ানমারে সহিংসতার হাত থেকে বাঁচতে গত তিন দশকে প্রায় ৩ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়েছে। এসব রোহিঙ্গা কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে বসবাস করছে।

রাখাইনে মাত্র ৭৯ হাজার রোহিঙ্গা: জিএডি বলছে, সর্বশেষ সংকট শুরুর আগে রাখাইনে রোহিঙ্গা ছিল ৭ লাখ ৬৭ হাজার ৩৮ জন। মংডু জেলার জিএডির জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তা বলেন, এ পরিসংখ্যান ২০১৬ সালে সংগ্রহ করা হয়েছিল।

জিএডি ও ইউএনওসিএইচএর রোহিঙ্গা পরিসংখ্যানে দেখা যায়, রাখাইনের প্রায় ৯০ শতাংশ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়েছে। এ ছাড়া পশ্চিম মিয়ানমারের তিনটি শহরে বর্তমানে রয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ অর্থাৎ ৭৯ হাজার ৩৮ জন রোহিঙ্গা।

তবে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা যে ৯০ ভাগ রোহিঙ্গার পরিসংখ্যান তুলে ধরা হয়েছে; তার মধ্যে নিহত, নিখোঁজ বা গ্রেফতারকৃতদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। এ ছাড়া দেশটির সেনা অভিযানে অভ্যন্তরীণ বাস্তুচ্যুত, নিহত রোহিঙ্গা, আহত হিন্দু বা রাখাইন জাতিগোষ্ঠীর মানুষকেও অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি পরিসংখ্যানে।

জিএডি বলছে, ‘মডু ও বুথিডংয়ের মোট জনগোষ্ঠীর যথাক্রমে ৯৩ ও ৮৪ শতাংশ রোহিঙ্গা। রাথেডং শহরে মাত্র ৬ শতাংশ রোহিঙ্গার বাস। রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলায় মংডু জেলার উপজাতি গোষ্ঠী ম্রো, থেট, হিন্দুসহ দেইঙ্গিত আরাকানিদের প্রায় ৩০ হাজার সদস্য গৃহহীন হয়েছে। বৌদ্ধসহ বাস্তুচ্যুত অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীর সদস্যরা ইতিমধ্যে মংডু শহরে ফিরে গেছে। অন্যদিকে, বাস্তুচ্যুত হিন্দুরা এখনও সরকারি পুনর্বাসনের অপেক্ষায় রয়েছে।

পরিচয়হীন রোহিঙ্গারা : জিএডির প্রতিবেদনে বাঙালি বা রোহিঙ্গা শব্দ দুটির কোনোটিই ব্যবহার করা হয়নি। এমনকি প্রতিবেদনে রোহিঙ্গাদের রাখাইনের সংখ্যালঘু মুসলিম জনগোষ্ঠী হিসেবেও উল্লেখ করেনি রাখাইনের এ স্থানীয় প্রশাসন।

২০১৬ সালে দেশটির নেত্রী অং সান সু চি রোহিঙ্গা শব্দটি ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের প্রতি আহ্বান জানান। সু চির আহ্বানের পর জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান নেতৃত্বাধীন রাখাইনের অ্যাডভাইসরি কমিশনের প্রতিবেদনেও রোহিঙ্গা শব্দটি কৌশলে এড়িয়ে যাওয়া হয়।

জিএডির প্রতিবেদনে রাখাইনের রোহিঙ্গাদের ‘বিদেশি’ এবং ‘বাংলাদেশি’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। এ ছাড়া তাদের বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারে পাড়ি জমানো অবৈধ অভিবাসী বলে চিহ্নিত করা হয়।

বিশ্বাস নেই কারও ওপর: গত সপ্তাহে বাংলাদেশ সফর করেছেন মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী লে. জেনারেল কিয়াও সোয়ে। বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিকভাবে তার হাতে ৮ হাজার ৩২ জন রোহিঙ্গার তালিকা তুলে দিয়েছে; যাদেরকে ফেরত নেয়া হতে পারে। এ তালিকায় আরসার কোনো সদস্য আছে কিনা তা শনাক্ত করতে চিরুনি অভিযান চালাচ্ছে মিয়ানমার সরকার।

বিপরীতে রাথেডং এবং বুথিডংয়ের প্রত্যন্ত অঞ্চলে এখনও লড়াই চলছে। মিয়ানমারের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারির শুরু থেকে গত ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত মংডুর দক্ষিণাঞ্চলে নতুন করে আশ্রয় নিয়েছে প্রায় ৩ হাজার ২০৬ জন। এ ছাড়া সমুদ্রের পাশে অপেক্ষা করছে আরও ৮০৪ জন।

কালের আলো/এএ/এমএইচএ

Print Friendly, PDF & Email