‘আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই’

প্রকাশিতঃ 8:49 pm | November 02, 2018

নিজস্ব প্রতিবেদক, কালের আলোঃ

দেশ ও জনগণের উন্নয়নে সরকারের নানা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা বলেছেন, আমার চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। আমি চাই এদেশের মানুষের ভাগ্যোন্নয়ন হবে। এদের মানুষ দু’বেলা পেট পুরে ভাত খাবে। কেউ গৃহহারা থাকবে না, সবার উন্নয়ন হবে।

এসময় তিনি দেশের মানুষের জন্য নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন জানিয়ে কবির ভাষায় বলেন, ‘নিঃস্ব আমি, রিক্ত আমি দেবার কিছু নাই/ আছে শুধু ভালোবাসা দিয়ে গেলাম তাই’।

শুক্রবার (২ নভেম্বর) বিকেলে ময়মনসিংহের ঐতিহাসিক সার্কিট হাউজ মাঠে স্থানীয় আওয়ামী লীগ আয়োজিত জনসভায় প্রধান অতিথির বক্তৃতা করছিলেন প্রধানমন্ত্রী। এর আগে সরকারপ্রধান মঞ্চের পাশে ১৯৫টি উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন।

বক্তৃতায় প্রধানমন্ত্রী ময়মনসিংহে আলাদা শিক্ষাবোর্ড, বিভাগীয় স্টেডিয়াম ও নভোথিয়েটার করার ঘোষণাও দেন। একইসঙ্গে নেত্রকোনায় বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং প্রতিটি উপজেলায় মডেল মসজিদ গড়ার কথাও বলেন।

বক্তব্যের শুরুতেই জাতির জনককে স্মরণ করে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, সদ্য স্বাধীন একটি দেশকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালে নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হয়। বাবা-মা-ভাই, সবাইকে হারিয়েছি। মানুষ তার আপনজনকে হত্যার বিচার চাইতে পারে, আমাদের সেই বিচার চাওয়ার সুযোগও দেওয়া হয়নি। ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার বন্ধ করতে চেয়েছিল জিয়াউর রহমান।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অবর্ণনীয় নির্যাতন করা হয়েছে জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। কিন্তু ২০০১ সালে ষড়যন্ত্র করে আমাদের ক্ষমতায় আসতে দেওয়া হলো না। সেসময় ক্ষমতায় এসে বিএনপি-জামায়াত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের হত্যা করে।

‘২০০২ সালের ৭ ডিসেম্বর ঈদের পর দিন ময়মনসিংহের ৪টি সিনেমা হলে বোমা ফুটলো। নিহত ১৮ জন। প্রায় ২০০ জন আহত হয়েছে। সেই সময় আমাদের আওয়ামী লীগ নেতা মতিউর রহমান ও জালাল উদ্দিনসহ অনেককে গ্রেফতার করে অত্যাচার করেছে। এই এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলের নারীদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন করেছে, গণধর্ষণ করেছে, ৭১’র পাক হানাদারদের মতো। আমাদের যুবলীগ নেতা কামরুজ্জামানের হাতের ১০টি আঙুল কেটে দিয়েছিলো। বসতবাড়ি দখল করে ওই গফরগাঁওয়ে রাতারাতি পুকুর করা হয়েছিল।’

খুন, হত্যা, দখল, চাঁদাবাজি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, বাংলা ভাই সৃষ্টি আর মানিলন্ডারিং এসব ছিলো বিএনপির কাজ- উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ওই সময় সরকার ছিলো হাওয়া ভবন। ওই হাওয়া ভবনের খাওয়া মেটাতে গেয়ে দেশের কোনো উন্নয়ন হয়নি, সব অর্থপাচার হয়েছে। ২০০৮ সালে দেশের জনগণ আওয়ামী লীগকে নৌকা মার্কায় ভোট দেয়। আর সেই ভোটে নির্বাচিত হয়ে আমরা সরকার গঠন করি। ২০০৮ থেকে আজ ২০১৮ প্রায় ১০ বছর আমরা আপনাদের সার্বিক উন্নয়নে ব্যাপক কাজ করেছি। আজকে আমি এই ময়মনসিংহ বিভাগ ঘোষণা দিয়েছি। এই বিভাগের সার্বিক উন্নয়নে আপনাদের জন্য আমি উপহার নিয়ে এসেছি। কিছুক্ষণ আগেই আমরা সেগুলো উদ্বোধন করেছি।

এরপর প্রধানমন্ত্রী ময়মনসিংহে উদ্বোধন ও ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করা ১৯৫টি প্রকল্পের নাম পড়ে শোনান।উন্নয়ন প্রকল্পের উদ্বোধন ও ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ছবি: পিআইডি২০১৪ সালে নির্বাচন ঠেকানোর নামে বিএনপি মানুষ পুড়িয়ে মারে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিএনপি-জামায়াত জোট ২০১৩, ২০১৪, ২০১৫ সালে নারকীয় তাণ্ডব চালিয়েছে। বিশেষ করে ২০১৪ সালে নির্বাচন ঠেকানোর নামে আগুন দিয়ে ৩ হাজার ৯শ’ মানুষকে পুড়িয়েছে। তারা ৫শ’ মানুষকে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। হাজার হাজার গাড়ি, রেললাইন, লঞ্চ পুড়িয়ে দিয়েছে। মানুষের স্বাভাবিকভাবে চলাফেরার কোনো অধিকার ছিলো না। এই বিএনপি ক্ষমতায় এসে নির্যাতন করে, আর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কোনো নির্যাতন করে না, দেশের উন্নয়ন করে, মানুষের কল্যাণ করে।

তিনি সরকারের উন্নয়ন কর্মসূচি সবিস্তারে তুলে ধরে বলেন, আমরা ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার সময় দেশের দারিদ্র্য যেখানে ৪০ শতাংশ ছিল, তা এই ১০ বছরে ২১ ভাগে নেমে এসেছে। আপনাদের সহযোগিতা চাই। আগে যেভাবে ভোট দিয়েছেন, আগামী দিনেও সেভাবে নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে আমাদের সহযোগিতা করবেন, যেন দারিদ্র্যসীমা ৫-৬ ভাগ কমাতে পারি।

প্রধানমন্ত্রী তারুণ্যের উদ্দেশ্যে বলেন, আমাদের যুবসমাজ-তরুণ সমাজই আমাদের শক্তি। আমরা শিক্ষাখাতে ব্যাপক উন্নয়ন করছি। প্রাইমারি থেকে উচ্চশিক্ষা পর্যন্ত ২ কোটি ৪ লাখ শিক্ষার্থীকে বৃত্তি-উচ্চবৃত্তি দিয়ে যাচ্ছি। যাতে আমাদের ছেলে-মেয়েরা লেখাপড়া শিখতে পারে। এর মধ্যে প্রাইমারি শিক্ষার ১ কোটি ৪০ লাখ মা, ওই প্রাইমারি শিশুদের উপবৃত্তি মায়ের কাছে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সরাসরি আমরা পৌঁছে দিচ্ছি মায়ের হাসি প্রকল্পের মাধ্যমে।

আওয়ামী লীগ সরকার প্রযুক্তিখাতে দেশকে এগিয়ে নিয়েছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ বাংলাদেশ ডিজিটাল। প্রতি উপজেলায় ব্রডব্যান্ড এবং ইন্টারনেট সার্ভিস চালু করেছি। আজকে আমরা মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উপৎক্ষেপণ করে মহাকাশ জয় করেছি। আমরা যে ডিজিটাল সেন্টার করে দিয়েছি, আপনারা সেখানে বসে নিজেরা অর্থ উপার্জন করতে পারেন। নিজের দেশে বসে বিদেশে অর্থ উপার্জন করতে পারেন, সেই সুযোগ করে দিয়েছি। আজ সবার হাতে হাতে মোবাইল। এটি বিএনপির সময় ছিলো না। ৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সবার হাতে মোবাইল ফোন পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা নেই।

দৃঢ়তার সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলতে থাকেন, আমরা কম্পিউটার শিক্ষার ব্যবস্থা করেছি। মাল্টিমিডিয়া ক্লাস রুম করে দিচ্ছি। কমিউনিটি ক্লিনিক করে দিয়ে জনগণের দোরগোড়ায় চিকিৎসার ব্যবস্থা করে দিয়েছি। ৩০ প্রকারের ওষুধ বিনা পয়সায় মা-বোনদের হাতে তুলে ধরছি। বাংলাদেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে।

সমাজের সব গোষ্ঠীর উন্নয়নে সরকার কাজ করছে জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, আমরা বিধবা, বয়স্ক ও প্রতিবন্ধী ভাতা দিচ্ছি। মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ সম্মানী ভাতা দিচ্ছি। প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের ভাতার ব্যবস্থা করেছি। সমাজে কেউ বাদ থাকবে না সবার উন্নয়ন হবে এই চিন্তা থেকেই রাষ্ট্র পরিচালনা করি। আমরা স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। এটা আমরা অর্জন করতে পেরেছি আপনারা নৌকায় ভোট দিয়েছেন বলে।

এসময় ময়মনসিংহ বিভাগবাসীর কাছে নৌকা মার্কায় ভোট চেয়ে প্রধানমন্ত্রী জনসভায় উপস্থিত জনতাকে হাত তুলে ওয়াদা করতে বলেন। জনতাও হাত তুলে ওয়াদা করার পর তাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বঙ্গবন্ধু কন্যা বলেন, আমার কোনো চাওয়া-পাওয়ার নেই। আপনাদের সেবা করা আমার কাজ। সকলে সুন্দরভাবে বাঁচবেন, উন্নত জীবন পাবেন সেটা আমরা চাই।

প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের আগে ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রথম প্রশাসক ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি মো. ইকরামুল হক টিটু প্রধানমন্ত্রীকে একটি চাবি উপহার দেন।

ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অ্যাডভোকেট জহিরুল হক খোকার সভাপতিত্বে এবং মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এহতেশামুল আলম ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুলের যৌথ সঞ্চালনায় জনসভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আব্দুর রাজ্জাক, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, ময়মনসিংহ-৬ (ফুলবাড়িয়া) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট মোসলেম উদ্দিন, ময়মনসিংহ-১০ (গফরগাঁও) আসনের সংসদ সদস্য ফাহমি গোলন্দাজ বাবেল, ময়মনসিংহ-২ (ফুলপুর-তারাকান্দা) আসনের সংসদ সদস্য শরীফ আহমেদ, ময়মনসিংহ সিটি করপোরেশনের প্রথম প্রশাসক ইকরামুল হক টিটু, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আমিনুল হক শামীম, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মোহিত উর রহমান শান্ত প্রমুখ।
কালের আলো/এএম

Print Friendly, PDF & Email